ট্রাম্পের নতুন শুল্কের ভার কার ঘাড়ে যাচ্ছে?

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: আল জাজিরার ভিডিও থেকে নেওয়া।
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: আল জাজিরার ভিডিও থেকে নেওয়া।

কানাডা, মেক্সিকো এবং চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে কার ঘাড়ে পড়তে যাচ্ছে এই শুল্কের বোঝা?

অবৈধ অভিবাসী ও মাদক পাচার ঠেকাতে কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট।

এছাড়া চীন ফেন্টানিল পাচার বন্ধ না করলে তাদের পণ্যের ওপর “যেকোনো অতিরিক্ত শুল্কের পাশাপাশি” ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। সেইসঙ্গে চীনকে ৬০ শতাংশ শুল্কের আওতায় আনাসহ সেখান থেকে আমদানিকৃত কিছু গাড়ির ওপর ২০০ শতাংশ কর আরোপেরও চিন্তাভাবনা করছেন ট্রাম্প।

ট্রাম্পের অর্থনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রীয় অংশ হচ্ছে শুল্ক; যাকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, চাকরি বাজারের সুরক্ষা এবং রাজস্ব কর বাড়ানোর উপায় হিসেবে দেখছেন।

আর নির্বাচনী প্রচারের সময় বলেছিলেন এই করের জন্য ‘আপনাদের খরচ হবে না; খরচ হবে অন্য দেশের।’

যাকে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিবিদরা বিভ্রান্তিকর বলে মত দিয়েছিলেন।

শুল্ক কীভাবে কাজ করবে?

প্রায়োগিগভাবে শুল্ক হচ্ছে এমন একটি দেশীয় কর যা কোনো পণ্য দেশে ঢোকার পর আরোপ করা হয় এবং তা পণ্যের মূল্যের ওপর নির্ধারিত হয়।

ধরা যাক, যুক্তরাষ্ট্র একটি গাড়ি আমদানি করলো যার মূল্য ৫০ হাজার ডলার। আর তা যদি ২৫ শতাংশ শুল্কের আওতায় পড়ে তবে গাড়িটির জন্য কর দিতে হবে সাড়ে ১২ হাজার ডলার।

এই কর মার্কিন কোম্পানিটিকেই পরিশোধ করতে হবে যারা গাড়িটি আমদানি করেছে; রপ্তানিকারক ওই বিদেশি কোম্পানিকে নয়।

সোজা পথে এই কর হচ্ছে এমন একটি কর যা মার্কিন কোম্পানিটি তার দেশের সরকারকে পরিশোধ করবে।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলারের মালামাল আমদানি করেছে, যা তার মোট জিডিপির প্রায় ১১ শতাংশের সমান। আর সেই বছর মোট আমদানি পণ্যের ওপরের শুল্ক থেকে আয় হয়েছিল ৮০ বিলিয়ন ডলার। যা মোট রাজস্ব আয়ের দুই শতাংশ।

তথ্যসূত্র: ওইসি

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই শুল্কের চূড়ান্ত অর্থনৈতিক বোঝা আসলে কোথায় পড়ে? প্রশ্নটি কিন্তু জটিলও বটে!

আমদানিকারক যদি শুল্ক খরচ পণ্য যে কিনছে তার ওপর চাপিয়ে দেয় তাহলে ক্রেতাকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে। এক্ষেত্রে শুল্কের এ বোঝাটি পড়বে মার্কিন ভোক্তার ওপর।

আর আমদানিকারক কোম্পানি ভোক্তার ওপর না চাপিয়ে নিজেই বহন করে তবে তার আগের চেয়ে কম মুনাফা কম হবে।

এছাড়া বিকল্প যেটি হতে পারে তাহলো রপ্তানিকারক কোম্পানি মার্কিন গ্রাহক ধরে রাখতে পণ্যের পাইকারি মূল্য শুল্কের সমান কমিয়ে দিতে পারে। এমন ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক কোম্পানির মুনাফা কমে যাবে। তাত্ত্বিকভাবে তিনটি পরিস্থিতিই সম্ভব।

কিন্তু অর্থনৈতিক সমীক্ষাগুলো বলছে, ট্রাম্প তার প্রথম দফা ২০১৭-২০২০ এ যে শুল্ক আরোপ করে তার ভার মার্কিন ভোক্তাদেরই বহন করতে হয়েছে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিকাগো ইউনিভার্সিটি একটি পরিচালনা করে। সেখানে দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, “শুল্ক আরোপ করা হলে তার একটি বড় অংশ মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে সেই দেশের ভোক্তাদের ওপরই বর্তায় তারা কি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত? জরিপে ৯৮ শতাংশ অর্থনীতিবিদই সহমত জানিয়েছিলেন।

মূল্যবৃদ্ধি

২০১৮ সালে ট্রাম্প ওয়াশিং মেশিন আমদানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। গবেষকদের ধারণা, এর সরাসরি প্রভাবে ওয়াশিং মেশিনের দাম এক লাফে ১২ শতাংশ বেড়ে যায়। প্রতিটি ওয়াশিং মেশিনের জন্য ভোক্তাকে ৮৬ ডলার বেশি ব্যয় করতে হয়। বছর শেষে দেখা যায়, শুধু একটি পণ্য কিনতেই ভোক্তাদের ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে।

তথ্যসূত্র: পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক্স

তাই এমন ভাবনার কোনো কারণ নেই যে ট্রাম্প প্রশাসনের আমদানি শুল্কের প্রভাব ভিন্ন হবে বা ভার অন্য কেউ বহন করবে।

পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনোমিক্সের ধারণা ট্রাম্পের নতুন শুল্কের ফলে মার্কিনদের আয় কমে যাবে। যার প্রভাব গরীবদের ৪ শতাংশ এবং সবচেয়ে ধনীদের জন্য ২ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

তাদের ধারণা অনুযায়ী, এই শুল্কের ফলে মধ্য আয়ের একটি মার্কিন পরিবার বছরের ১৭শ’ ডলার হারাবে।

তবে মধ্য বামপন্থী বিশ্লেষক সংস্থা সেন্টার ফর আমেরিকান কংগ্রেস ভিন্ন পদ্ধতি নিরূপণ করে জানায়, এর কারণে একটি মধ্য আয়ের পরিবার বছরে আড়াই হাজার থেকে প্রায় চার হাজার ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

বড় আকারের শুল্ক আরোপ হলে দেশে মূল্যস্ফীতি আবারও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন আরও অনেক গবেষকরা।

চাকরিতে প্রভাব

ট্রাম্প তার নতুন শুল্ক আরোপের জন্য আরও একটি অর্থনৈতিক যুক্তি ব্যবহার করেছেন; আর তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এবং চাকরির সুরক্ষা।

নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প বলেন, “আমার পরিকল্পনায় মার্কিনিদের বিদেশিদের কাছে চাকরি হারানোর ভয় থাকবে না। বরং বিদেশিরা মার্কিনিদের কাছে চাকরি হারানোর ভয়ে ভীত হবে।”

তবে ট্রাম্পের এ শুল্ক আরোপের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট হিসেবে ১৯৯৪ সালে মেক্সিকোর সাথে নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট এবং ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের প্রবেশের পর সস্তা শ্রম বাজারের কারণে উৎপাদন খাতে মার্কিনিদের চাকরি হারানোর দীর্ঘদিনের উদ্বেগ কাজ করছে।

১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে নাফটা বাস্তবায়িত হওয়র সময় যুক্তরাষ্ট্রে ১৭ মিলিয়ন উৎপাদন চাকরি ছিল। ২০১৬ সালে তা নেমে ১২ মিলিয়নে দাঁড়ায়।

তবে অর্থনীতিবিদরা এ পতনের জন্য শুধু বাণিজ্যকে মানতে নারাজ। তারা মনে করেন, উৎপাদনখাতে স্বয়ংক্রিয়তাও চাকরি কমার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করছে।

সেইসঙ্গে ট্রাম্পের আগের মেয়াদে শুল্কের প্রভাব নিয়ে কাজ করা গবেষকরাও এর ফলে শিল্পক্ষেক্রে সামগ্রিক কর্মসংস্থানের ওপর ইতিবাচক কোনো প্রভাব খুঁজে পাননি।

মার্কিন উৎপাদনকারীদের সুরক্ষায় ২০১৮ সালে ট্রাম্প স্টিল আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। এ ক্ষেত্রে ২০২০ সালে মোট কর্মসংস্থান ছিল ৮০ হাজার। আর ২০১৮ সালে শুল্ক আরোপের সময় যা ছিল ৮৪ হাজার।

তাত্ত্বিকভাবে হয়তো মনে হতে পারে যে, এ সেক্টরে শুল্ক না থাকলে কর্মসংস্থান আরও কমে যেতে পারত। তবে বিষয়ক গবেষণাগুলো থেকে পাওয়া তথ্যে কোনো ইতিবাচক প্রভাবই দেখা যায়নি।

উল্টো অর্থনীতিবিদরা দেখতে পান যে শুল্কের ফলে স্টিলের দাম বাড়ায় যারা কাঁচামাল হিসেবে স্টিল ব্যবহার করত তারা উৎপাদনখাতে কর্মী কমিয়ে দিয়েছে।

বাণিজ্য ঘাটতিতে প্রভাব

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের ঘাটতির সমালোচনা করেছন। তিনি বলেন, বাণিজ্য ঘাটতি অর্থনীতিকে বাজেভাবে ক্ষতি করে।”

ট্রাম্প প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার কিছু আগে ২০১৬ সালে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৪৮০ বিলিয়ন ডলার; যা যুক্তরাষ্ট্রে মোট জিডিপির ২.৫ শতাংশ। শুল্ক আরোপের পরও ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫৩ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপি ৩ শতাংশ

২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন চীন থেকে আমদানিকৃত সোলার প্যানেলের ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালে এক প্রমাণ দেখায় যে, এই শুল্কের কারণে চীন তাদের কাজ মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামে স্থানান্তর করে শুল্ক এড়িয়ে গিয়েছে।

কোয়ালিশন ফর আ প্রস্পেরাস আমেরিকার জেফ ফেরি এর মতো কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনাকে মার্কিন শিল্পের উন্নতি ঘটাবে বলে মনে করলেও তা খুবই নগণ্য হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন।

আমেরিকান কমপাসের পরিচালক অরেন কাস মনে করেন, শুল্কের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রে আরও বেশি উৎপাদন কার্যক্রম রাখতে পারে। যাকে তিনি জাতীয় প্রতিরক্ষা এবং সরবরাহ চেইন সুরক্ষার জন্য উপকারী বলে মনে করছেন।

বিদায়ী জো বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের শুল্কের সমালোচনা করলেও তারা ২০১৮ সালে আরোপিত করগুলো বজায় রেখেছিলেন। এছাড়া তারা জাতীয় নিরাপত্তা, মার্কিন শিল্প নীতি এবং বেইজিংয়ের অস্বাভাবিক ভর্তুর্কির যুক্তি দেখিয়ে চীন থেকে আমদানি করা বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর নতুন করে কর আরোপ করে।

বিবিসি অবলম্বনে লিখেছেন মাহবুবা ডিনা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads