যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দেশের প্রধান তিন বাণিজ্যিক অংশীদার কানাডা, মেক্সিকো ও কানাডার ওপর যে শুল্ক আরোপ করেছেন তার জন্য দেশটির ভোক্তা ও ব্যবসাগুলোর খরচ বেড়ে যেতে পারে।
কানাডার কিছু জ্বালানি পণ্য ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে চীন, মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক বসেছে। এর মধ্যে চীন থেকে আমদানি করা পণ্যে অন্তত ২০ শতাংশ এবং মেক্সিকো ও কানাডার পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
ট্রাম্পের এ শুল্কের প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দাদের ওপর তাৎক্ষণিক না পড়লেও আমদানিকারকরা সেই পণ্যগুলোর দাম বাড়িয়ে দিতে পারেন। কেননা ট্রাম্প যে দেশগুলোর ওপর তার নতুন এ শুল্ক আরোপ করেছেন, গত বছর সেই দেশগুলো থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি পণ্যের ৪০ শতাংশের বেশি এসেছিল।
তবে দাম কতটা এবং কখন বাড়বে তা নির্ভর করছে আমদাকিকারকরা শুল্কের উচ্চ খরচ কতটুকু বহন করবেন বা খরচ কমানোর জন্য তাদের সরবরাহ ব্যবস্থা কিভাবে পুনর্গঠন করবে এবং তাদের পণ্যের মজুদের ওপর।
নতুন শুল্কের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দারা যেসব ক্ষেত্রে চাপ অনুভব করতে পারেন তার মধ্যে রয়েছে খাবার থেকে শুরু করে ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী, খেলনা, অ্যাপ্লায়েন্স, গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ রয়েছে।
খাদ্য
মেক্সিকো ও কানাডা বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সরবরাহ করে থাকে। মেক্সিকো থেকে আসে ফল ও শাকসবজির বড় অংশ। কানাডা সরবরাহ করে থাকে শস্য, মাংস, মুরগি ও অন্যান্য প্রাণজ পণ্য।
শুল্কের কারণে মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আসা কৃষি পণ্য ভোক্তাদের জন্য আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে। কারণ খুচরা বিক্রেতারা অন্য শিল্পের তুলনায় কম মুনাফা মার্জিনে কাজ করায় উচ্চতর শুল্ক খরচ গ্রাহকদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান টার্গেটের প্রধান নির্বাহী (সিইও) ব্রায়ান কর্নেল মঙ্গলবার সিএনবিসিকে বলেন, শুল্কের কারণে মেক্সিকো থেকে আসা ফলমূল ও শাকসবজির দাম এই সপ্তাহেই বাড়তে পারে। কেননা শীতকালে টার্গেট মেক্সিকো থেকে ফলমূল এবং শাকসবজি আমদানির ওপরই ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

তিনি বলেন, “আমরা এসব জায়গায় মূল্য কমানোর চেষ্টা করব; তবে ভোক্তারা পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যেই মূল্য বৃদ্ধি দেখতে পাবেন।”
সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র আমদানির তুলনায় কৃষি পণ্য রপ্তানি বেশি করলেও গত দশকে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মেক্সিকোর মতো দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে; যেখানে চাষাবাদের পরিস্থিতি অনুকূল।
ইউএসডিএর তথ্য অনুসারে গত বছর মেক্সিকো থেকে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র। যার মধ্যে রয়েছে ৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের তাজা সবজি, ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের বিয়ার ও ৫ বিলিয়ন ডলারের মদ।
মেক্সিকো থেকে গত বছরে কৃষি আমদানির সবচেয়ে বড় অংশ ছিল তাজা ফল। ৯ বিলিয়ন ডলারের ফলের মধ্যে অ্যাভোকাডোই ছিল ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের।
মেক্সিকো, কানাডা ও চীনের ওপর শুল্ক ছাড়াও ট্রাম্প সোমবার কৃষিপণ্য আমদানির আলাদা শুল্কের প্রস্তাব দিয়েছেন। যার ফলে বিশ্বব্যাপী খাবারের দাম আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী, খেলনা ও অ্যাপ্লায়েন্স
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেডের তথ্য অনুযায়ী গত বছর চীন থেকে আমদানি করা শীর্ষ পণ্যের মধ্যে ভোক্তা ইলেকট্রনিক সামগ্রী ছিল। যার মধ্যে রয়েছে সেলফোন, টিভি, ল্যাপটপ, ভিডিও গেম কনসোল, মনিটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি।
এছাড়া চীন গৃহস্থালি যন্ত্রপাতিরও বড় সরবরাহকারী। এসব পণ্য ছাড়াও আমদানি করা খেলনা ও জুতার বাজারও ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির সম্মুখীন।
ফুটওয়্যার ডিস্ট্রিবিউটরস অ্যান্ড রিটেইলারস অব আমেরিকা (এফডিআরএ) অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া জুতার ৯৯ শতাংশই আমদানি করা।

বিশ্বখ্যাত জুতার ব্র্যান্ড নাইকি, স্টিভ ম্যাডেন, কোল হ্যানসহ অন্যান্য ফুটওয়্যার ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থাটি জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া জুতার ৫৬ শতাংশই চীনে তৈরি।
এ ছাড়া খেলনা ও ক্রীড়া সরঞ্জাম যেমন ফুটবল, সকার বল ও বেসবল চীন থেকে আসে। যুক্তরাষ্ট্র তার আমদানি করা খেলনা ও ক্রীড়া সরঞ্জামের ৭৫ শতাংশই চীন থেকে পায়।
গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ
যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া গাড়িগুলোও এখন আর সম্পূর্ণভাবে সেখানে তৈরি নয়। অনেক ক্ষেত্রে গাড়ি তৈরি হওয়ার আগে বিভিন্ন অংশ একাধিকবার মেক্সিকো ও কানাডার সীমান্ত পার হয়ে প্রতিবেশী দেশদুটিতে সমাপ্ত হয়।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল মবিলিটির অটোমোটিভ ইকোনমিস্ট পিটার ন্যাগল বলেন, “আজকের বাজারে এমন কোনো যানবাহন নেই যা শুল্কের কারণে প্রভাবিত হবে না। আমি মনে করি শুল্ক কার্যকর হওয়ার এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে দাম পরিবর্তিত হতে শুরু করবে।”
মিশিগান-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যান্ডারসন ইকোনমিক গ্রুপের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শুল্কের ফলে উত্তর আমেরিকায় গাড়ি উৎপাদনের খরচ সাড়ে তিন হাজার থেকে ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এই উচ্চ খরচের কারণে কিছু নির্দিষ্ট মডেল বিশেষ করে কম দামের গাড়িগুলো তৈরি করা লাভজনক নাও হতে পারে।
গ্রুপের সিইও প্যাট্রিক অ্যান্ডারসন বলেন, ফলে উৎপাদন এবং শিল্পের কর্মসংস্থানে ছাঁটাইয়েরও সম্ভাবনা রয়েছে।
উৎপাদকরা কিছু মডেল বানানোও বন্ধ করে দিতে পারেন বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
এছাড়া তিনি বলেন, ট্রাম্পের এ ঘোষণার পর অটোবাইল কোম্পানিগুলো রাতারাতি যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়ে যেতে পারবে না। বিষয়টা সময় এবং খরচ সাপেক্ষও।