খালার ‘দুর্নীতি বিতর্কে’ টিউলিপের হোঁচট?

tulip-sheikh-hasina-putin

এক দশক আগে টিউলিপ সিদ্দিক যখন যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টির হয়ে প্রথম এমপি হন, তখন তিনি বলেছিলেন, তার রাজনীতির হাতে খড়ি খালা শেখ হাসিনার কাছে। শেখ হাসিনা তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করছেন। তার আগে ২০০৮ সালে যে নির্বাচনে তিনি ক্ষমতায় গিয়েছিলেন, তখন টিউলিপও আওয়ামী লীগের হয়ে প্রচার চালাতে দেশে এসেছিলেন।

তার কয়েক বছরের মাথায় ২০১৫ সালে লেবার পার্টির হয়ে এমপি নির্বাচিত হয়ে টিউলিপ যান যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমন্সে। রুশনারা আলীর পর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি পেয়ে প্রবাসীরা ছিল উল্লসিত। দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। তাদের চোখে টিউলিপের মূল পরিচয় তো বঙ্গবন্ধুর নাতনি।

এমপি টিউলিপ কবে মন্ত্রী হবেন, সেই আশায় বসেছিলেন দেশে ও প্রবাসে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা। গত বছরের জুনে তাদের সেই আশাও পূরণ হয়ে যায়। টানা চতুর্থবার এমপি হন টিউলিপ, সেই সঙ্গে ১৪ বছর পর যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টিকে ক্ষমতায় ফেরানো কিয়ার স্টারমার তার বন্ধু টিউলিপকে করেন সিটি মিনিস্টার। আর্থিক খাতের দুর্নীতি মোকাবেলার দায়িত্ব এই মন্ত্রীর।

তার দুই মাস না যেতেই স্বদেশ থেকে দুঃসংবাদ যায় টিউলিপের কাছে। গত বছরের জানুয়ারিতে টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু সরকার পতনের পর দেশ ছাড়তে হয় তাকে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে টিউলিপের মা শেখ রেহানাও একই বিমানে চড়ে ভারতে গিয়েছিলেন। পরে বোনকে রেখে রেহানা ফিরে যান যুক্তরাজ্যে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আগে থেকেই তুলছিল পশ্চিমা মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো। এমপি ও মন্ত্রী হওয়ার পর টিউলিপ তার সুর পাল্টে বাংলাদেশে তার খালার রাজনৈতিক বিষয়াদিতে নিজের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা না থাকার কথাই বলতে থাকেন। 

কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একের পর এক অভিযোগে ভরতে থাকে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রগুলোর পাতা। আর তার সবক’টির সঙ্গে শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসতে থাকে। এই সমালোচনার মুখে নিজেকে নিয়ে তদন্তের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর স্বাধীন উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনেসকে চিঠি দেন তিনি।

টিউলিপ নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও যুক্তরাজ্যের বিরোধী রক্ষণশীল দলের নেতারা টিউলিপের পদত্যাগের দাবি জোরেশোরে তোলেন। তারা বলেন, যার দায়িত্ব দুর্নীতি ঠেকানো, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তার আর দাায়িত্বে থাকা চলে না।

প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ছায়া দিয়েই ছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে স্টারমারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা, তার ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ভ্রমণ, শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার খবরগুলোও নতুন করে জেগে ওঠে।

ফলে স্টারমারও পড়েন বিপদে। আর তা দেখে টিউলিপ মঙ্গলবার সিটি মিনিস্টারের দায়িত্ব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। প্রধানমন্ত্রী স্টারমারকে দেওয়া চিঠিতে তিনি বলেন, তদন্তে তার বিরুদ্ধে কোনো দোষের প্রমাণ পাওয়া না গেলেও তার মন্ত্রীর পদে থেকে যাওয়া সরকারের কাজে প্রতিবন্ধক হবে, যা তিনি চান না।

টিউলিপ লিখেছেন, যদিও তিনি মন্ত্রীর আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি, তবুও তার এই পদ ধরে রাখা সরকারের কাজের গতিতে প্রতিবন্ধকতা হবে। তাই তার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত। পদত্যাগের এই কারণ ব্যাখ্যা করে এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন টিউলিপ। পাশাপাশি সেখানে নিজের পদত্যাপত্রটির ছবি দিয়েছেন।

মন্ত্রীর দায়িত্ব ছাড়লেও হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাউগেট আসনে লেবার পার্টির এমপি হিসাবে কাজ করে যাবেন টিউলিপ।

টিউলিপের পদত্যাগপত্র গ্রহণের কথা জানিয়ে স্টারমার ফিরতি চিঠিতে লিখেছেন, তিনি ব্যথিত চিত্তে এই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করছেন। তবে টিউলিপের জন্য দরজা খোলা রইল।

তিনি বলেন, “আমি এখানে এটা স্পষ্ট করতে চাই, স্যার লরি ম্যাগনাস একজন স্বাধীন উপদেষ্টা হিসাবে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে তিনি তার তদন্তে টিউলিপের বিরুদ্ধে মন্ত্রী হিসাবে আচরণবিধি ভঙ্গ কিংবা তার আর্থিক কোনও অনিয়মের প্রমাণ পাননি তিনি।”

প্রধানমন্ত্রী স্টারমারকে লেখা এক চিঠিতে লরি ম্যাগনাস বলেছেন, বাংলাদেশে তার পরিবারের কারণে টিউলিপ সম্মানহানির ঝুঁকিতে রয়েছেন।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারিয়ে দেশ ছাড়ার পর তার দল আওয়ামী লীগও বড় দুর্দশায় পড়েছে। দেশের প্রাচীন এই দলটির নেতা-কর্মীদের কেউ প্রকাশ্যে নেই। কেউ কারাগারে, কেউ বিদেশে, কেউ দেশেই লুকিয়ে। আওয়ামী লীগকে আর রাজনীতিতে ফিরতে না দেওয়ার ঘোষণাও আছে দলটির বিরোধীদের, যাদের সঙ্গে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর নিবিড় সম্পর্ক থাকার কথা বলে আসছে আওয়ামী লীগ।   

পাঁকে পড়ে বিপাকে

দেশে দুর্দশায় থাকা আওয়ামী লীগের একটি সান্ত্বনা ছিল যে যুক্তরাজ্যে তাদের পরিবারের একজন মন্ত্রী আছেন। এখন তাও হারালেন এবং তা আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতার কারণেই।

২০১৫ সাল থেকে চারবারের এমপি টিউলিপের বিরুদ্ধে এতদিন কোনো অভিযোগ ওঠেনি। কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর পুরনো ঘটনায় সব অভিযোগ উঠতে থাকে একের পর এক। আর যুক্তরাজের সংবাদপত্রগুলোতে সেই সব প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার নাম লেখা হচ্ছিল ‘স্বৈরাচার’ হিসাবে। 

রূপপুর পারমাণিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে টিউলিপের নামও যখন বাংলাদেশে দুদকের তদন্তে উঠে আসে, সেই খবর বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রগুলো। সেই সঙ্গে ২০১৩ সালে মস্কোতে এই প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শেখ হাসিনার পাশে টিউলিপের হাস্যোজ্জ্বল ছবিও নতুন করে প্রকাশ হয়।

গত অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কয়েকদিন আগে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রে খবর আসে, লন্ডনে একটি ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া ভাড়া নিজের আয়ের খাতে দেখাননি টিউলিপ।

সেই অভিযোগের তদন্তের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে অন্যের মালিকানায় থাকা একটি বিলাসবহুল বাড়িতে বিনা ভাড়ায় বসবাসের অভিযোগও ওঠে।

২১ লাখ পাউন্ড দামের বাড়িটির মালিক আব্দুল করিম নামে বাংলাদেশি এক ব্যবসায়ী। শেখ হাসিনা ওই ব্যবসায়ীকে বাংলাদেশে সিআইপি ঘোষণা করে ভিআইপির মর্যাদা দিয়েছিলেন, এমন তথ্যও তুলে ধরে ডেইলি মেইল।

এরপর টিউলিপের বিরুদ্ধে সেন্ট্রাল লন্ডনে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিনা খরচে ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগ সামনে আসে। আব্দুল মোতালিফ ওই ব্যবসায়ী আবার তার খালা শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট।

যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতে দুর্নীতি দমনের দায়িত্বপ্রাপ্ত টিউলিপ ২০০৪ সালে লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় দুই বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্ট বুঝে নেন, তবে তার জন্য কোনও অর্থ পরিশোধ করেননি তিনি।

এরপর টিউলিপের ছোট বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীরও লন্ডন বিনামূল্যে আরেকটি ফ্ল্যাট পাওয়ার খবর আসে সানডে টাইমসে।

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপ উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেডের এমন একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন, যেটি তার পরিবারকে দিয়েছেন শেখ হাসিনার এক সমর্থক। ফ্ল্যাটটি আজমিনাকে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছিল।

হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটি ২০০৯ সালে আজমিনাকে হস্তান্তর করেন বাংলাদেশি আইনজীবী মঈন গণি। তার সঙ্গে শেখ হাসিনার ছবি থাকার কথাও জানায় সানডে টাইমস।

সর্বশেষ দুদিন আগে লন্ডনের টাইমস পত্রিকার এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, টিউলিপের বড় ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে প্রপাগান্ডা ছড়ানোয় যুক্ত ছিলেন।

শেখ রেহানাও বিনা ভাড়ায় শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়ান রহমানের মালিকানাধীন একটি ফ্ল্যাটে থাকেন বলেও খবর আসে।

এছাড়া ঢাকার পাশে পূর্বাচলে মা শেখ রেহানা, ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীর নামে নিয়ম ভেঙে প্লট নেওয়ার অভিযোগে যে তিনটি মামলা হয়েছে, সবগুলোতেই টিউলিপ আসামি।

এমন একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকায় টিউলিপ মন্ত্রী থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন বলে সরব হন বিরোধী দলের নেতারা। তারা টিউলিপকে পদত্যাগ করার আহ্বানও জানান।

টোরি দলের এমপি বব ব্ল্যাকম্যান সাংবাদিকদের বলেন, “এসব অভিযোগের বিষয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের তার অবস্থান ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। যদি তিনি তা না করেন, তবে মন্ত্রী থাকার যোগ্যতা তার আর থাকে না।”

টোরি দলের আরেক এমপি ও ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাট ভিকার বলেন, “সরকারের একজন সদস্যের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ একেবারে মানা যায় না, আর এটা আরও বড় হয়ে ওঠে, যখন দুর্নীতি প্রতিরোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ওঠে।”

রূপপুর প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর টিউলিপকে যুক্তরাজ্যের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জেরা করে বলে খবর আসে। তখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারও টিউলিপের পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, সিটি মিনিস্টারের প্রতি পূর্ণ আস্থা আছে তার।

তবে আরও অভিযোগ আসার পর স্টারমারের ওপরও চাপ বাড়ে। তখন গত সপ্তাহে টিউলিপ প্রধানমন্ত্রীর ইথিকস অ্যাডভাইজর স্যার লরি ম্যাগনাসকে চিঠি দেন তাকে নিয়ে তদন্ত করতে।

টিউলিপ অবশ্য তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে ওই চিঠিতে বলেন, তার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে অপপ্রচার চলছে। তাই তদন্তের মাধ্যমেই প্রমাণ হোক, আসলে তিনি মন্ত্রী পদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছেন কি না?

“গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাকে নিয়ে একের পর এক মিডিয়া রিপোর্ট হচ্ছে। সেখানে বেশিরভাগ তথ্যই সঠিক নয়। আমার পারিবারিক সম্পর্ক ধরেও লেখা হচ্ছে। আমি আমার কাছে স্পষ্ট, কোনো অনিয়ম আমি করিনি। তারপরও সংশয় ঘোচানোর জন্য আমি চাই আপনি তদন্তের মাধ্যমে সত্য কথাটি তুলে আনবেন।”

সেই তদন্তে দোষ প্রমাণিত না হলেও নিজ থেকেই সরে দাঁড়ান টিউলিপ; ফলে আট মাসের মধ্যে তার মন্ত্রিত্বের অবসান ঘটল।

বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকীর মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের জন্ম ১৯৮২ সালে লন্ডনে। ১৫ বছর বয়স থেকে তিনি হ্যাম্পস্টিড ও কিলবার্নে বসবাস করছেন। ওই এলাকায় স্কুলে পড়েছেন তিনি, কাউন্সিলরের দায়িত্বও পালন করেন।

কিংস কলেজ, লন্ডন থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গভর্নমেন্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া টিউলিপ লেবার পার্টিতে যোগ দিয়ে ২০১৫ সালে হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্ন আসন েথকে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। এরপর টানা দুটি নির্বাচনে ওই আসনে লেবারদের পতাকা উড়িয়ে রাখেন তিনি। গত বছরের জুলাইয়ের নির্বাচনে হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন তিনি। তারপরই সিটি মিনিস্টার করা হয় তাকে।

টিউলিপ বিয়ে করেন ২০১৩ সালে। তার স্বামীর নাম ক্রিশ্চিয়ান পার্সি। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। 

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads