‘ভুয়া আদালতের’ রায়ে বিচলিত নন টিউলিপ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক।

পূর্বাচলের ছয়টি প্লট নিয়ে শেখ হাসিনার পরিবারের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই প্লটগুলোর মধ্যে কোনোটিতেই শেখ হাসিনার ভাগ্নি ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের নাম না থাকলেও সাজা শুনিয়েছে বাংলাদেশের আদালত।

আদালত তার সাজা দেওয়ার কারণ সম্পর্কে বলেছে, তিনি তার মা শেখ রেহানার নামে রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে একটি প্লট বরাদ্দে তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েছিলেন।

ওই রায়ের পর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় টিউলিপ সিদ্দিক বলেছেন, প্লট দুর্নীতির অভিযোগে তার অনুপস্থিতিতে যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে বিচার সম্পন্ন হয়েছে, তা ‘ত্রুটিপূর্ণ ও প্রহসনমূলক’। এ রায়কে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু তিনি দেখছেন না।

“এই পুরো প্রক্রিয়া শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ এবং প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টের’ ফলাফল যেমন অনুমানযোগ্য ছিল, তেমনি এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।”

তিনি আরও বলেন, আশা করছি এই তথাকথিত ‘রায়’ যথাযোগ্য অবজ্ঞার সঙ্গেই বিবেচিত হবে। আমার মনোযোগ সবসময়ই আমার নির্বাচনী এলাকা হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেটে। বাংলাদেশের নোংরা রাজনীতির মাধ্যমে আমি বিভ্রান্ত হতে চাই না।”

ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম সোমবার রায়ে টিউলিপকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি তার মা শেখ রেহানাকে ৭ বছর কারাদণ্ড এবং খালা, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৫ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন।

মামলার অভিযোগ ছিল, ঢাকা শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা আবাসন সুবিধা থাকার পরেও ‘সেই তথ্য গোপন করে আইন ভেঙে দুর্নীতির মাধ্যমে’ শেখ রেহানা পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ নেন। শেখ হাসিনা ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করে বোনকে প্লট বরাদ্দে ‘সহায়তা’ করেন। এবং ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক তার মা রেহানাকে প্লট পাইয়ে দিতে খালা শেখ হাসিনাকে ‘প্রভাবিত’ করেন।

টিউলিপ শুরু থেকেই বলে আসছেন, তার বিরুদ্ধে এসব ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার’।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট পর শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। বোন শেখ রেহানা সে সময় তার সঙ্গে গেলেও পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান।

তাদের ‘পলাতক’ দেখিয়ে এ মামলার বিচার কাজ চলে। ফলে তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী মামলা লড়ার সুযোগ পাননি।

যুক্তরাজ্যের পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে লেখা এক চিঠিতে এ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন।

চিঠিতে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রতিমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক এই মামলা লড়ার “ন্যূনতম অধিকারও পাননি”; অভিযোগ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা বা আইনজীবীর নিয়োগের সুযোগ–“কিছুই তিনি পাননি।”

বাংলাদেশে টিউলিপ যাকে আইনজীবীকে হিসেবে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন, তাকে “সরে দাঁড়াতে বাধ্য করার পাশাপাশি গৃহবন্দি করা হয় এবং তার মেয়েকে হুমকিও দেওয়া হয়” বলেও অভিযোগ করা হয় ওই চিঠিতে।

সোমবার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক রবিউল আলম বলেন, “বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ায় পৃথিবীর যেখানে অবস্থান করুক না কেন সেই আসামিকে বিচার করতে আইনে কোনো বাধা নেই। কেবলমাত্র মৃত্যুদণ্ডের ধারার মামলার ক্ষেত্রে পলাতক আসামির ক্ষেত্রে স্টেট ডিফেন্স (রাষ্ট্রনিযুক্ত) ল ইয়ার নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে।

“এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের কোনো ধারার অভিযোগ না থাকায় আসামিদের জন্য ডিফেন্স ল ইয়ার নিয়োগ প্রদানের কোনো সুযোগ নেই।”

পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে দুদকের মামলায় টিউলিপের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রতিক্রিয়ায় গত এপ্রিলে তার আইনজীবী অভিযোগ করেন, দুদক ‘প্রামাণিক নথির ভিত্তিতে’ টিউলিপের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানোর কথা বললেও কোনো প্রামাণিক নথি উপস্থাপন করেনি।

সেই সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টায়ও ‘সাড়া দেয়নি’। তাতে টিউলিপের ‘ন্যায়বিচারের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত’ হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এ লেবার এমপির আইনজীবীরা।

অন্যদিকে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন সে সময় বলেছিলেন, টিউলিপ নির্দোষ হলে কেন পদত্যাগ করলেন?

“কেন তিনি তার আইনজীবীদের দুদকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন? দুদক তার আইনজীবীকে ইমেইলের মাধ্যমে অনুরোধ জানিয়েছে, যেন বাংলাদেশে এই মামলার আইনি লড়াইয়ে অংশ নেন।”

গত বছরের মাঝামাঝিতে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যে সরকার গঠন করে লেবার পার্টি, যাতে আর্থিক সেবা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান টানা চারবারের এমপি টিউলিপ সিদ্দিক।

বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকীর মেয়ে টিউলিপ প্রথমবার এমপি হন ২০১৫ সালে। পরে ২০১৭ ও ২০১৯ সালেও পুনঃনির্বাচিত হন।

লন্ডনের মিচামে জন্মগ্রহণ করা টিউলিপের শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরে। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গভর্মেন্ট বিষয়ে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে।

আরও পড়ুন