বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র এখনও এক তরীতেই

eric-garcetti-us-ambassador-ito-ndia

গেল বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের আকস্মিক পতন ভারতের জন্য যেমন ছিল অপ্রত্যাশিত, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রকেও ফেলে দিয়েছিল বেকায়দায়।

বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের এক সঙ্গে চলার নীতির স্বরূপ উন্মোচন করে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০ দিন পর একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ওয়াশিংটন পোস্ট।

সেখানে বলা হয়েছিল, শেখ হাসিনার পক্ষে থাকতে ওয়াশিংটনকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছিল নয়া দিল্লি। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বোঝানো হচ্ছিল, শেখ হাসিনার পতন ঘটলে বাংলাদেশও আফগানিস্তানের মতো হবে।

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কাছ থেকে সেই বুঝ নিয়ে জো বাইডেন সরকার র‌্যাবের ওপর এক নিষেধাজ্ঞা এবং নতুন ভিসা নীতি দেওয়ার পর বাংলাদেশ নিয়ে আর কঠোর হয়নি।

এমনকি ঢাকায় তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও ওয়াশিংটনের কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ পরিস্থিতি বোঝাতে পারেননি, তেমনটাই লিখেছিল ওয়াশিংটন পোস্ট।

তাতে ইঙ্গিত ছিল, ৫ আগস্ট ঢাকা ওলট-পালট হওয়ার পর ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা ভারতের চোখে বাংলাদেশকে না দেখে এবারর নিজেদের চোখে বাংলাদেশ দেখতে চাইবে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল তখনও বলেছিলেন, বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটন যোগাযোগ রেখে চলছে।

কিন্তু শেখ হাসিনার বিদায়ের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যিনি হয়েছেন, সেই মুহাম্মদ ইউনূস পশ্চিমাদের কাছে লোক হিসাবেই পরিচিত। তার সরকারের সময়ে আবার ঢাকা ও দিল্লি সম্পর্কের ঘটেছে অবনতি।

এই অবস্থায় ওয়াশিংটন বাংলাদেশ নিয়ে স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে চলতে পারে, সেই ধারণাই ছিল অনেকের। আসলেই কি তাই?

নয়া দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটির কথায় তা মনে হচ্ছে না। বরং ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, দুই দেশ আবার একই পথে হাঁটছে।

ভারতীয় টেলিভিশন ইয়নকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গারসেটি বলেছেন, বাংলাদেশ নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশ একই নীতিতে রয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি জুড়ে দিয়েছেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এর আগে এত ঘনিষ্ঠভাবে কখনও কাজ করেনি।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনকে ঠেকানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের এক গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী ভারত। তাই প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারতের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ভালো চোখে না দেখলেও সয়ে েযেতে হয় ওয়াশিংটনকে।

বাইডেন প্রশাসন বিদায়ের পথে, ব্যবসায়ী ট্রাম্প ২০ জানুয়ারিই প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে আবার নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও দুই দেশের সম্পর্ক আরও নিবিড় করতে পারে, এমন ধারণা করা হয়।

আন্দোলন দানা বাঁধার মধ্যে বেইজিং সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ছুটে  আসার পরের মাসেই শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটার পর ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূতের দৌড়-ঝাঁপ ছিল চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশে তাদের প্রচুর বিনিয়োগ থাকায় নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষা করা তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

ইয়ন টিভির ভারতীয় সাংবাদিক সিদ্ধান্ত সিবাল সেই চীনকে জড়িয়েই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে প্রশ্নটি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমরা দেখছি শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়েছেন (ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন)। এটা ভারতের জন্য ছিল বড় ধাক্কা। এরমধ্যে সেখানে আবার জামায়াতের উত্থান ঘটেছে, সেই সঙ্গে চীনের সম্পৃক্ততাও বাড়ছে। আপনার কী মনে হয়?”

জবাবে গারসেটি বলেন, “আমি মনে করি, আমরা উভয়ই অভিন্ন নীতিতে আছি। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক দক্ষিণ এশিয়া। এক্ষেত্রে আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করে যাচ্ছি।

“আমরা স্পষ্ট করেই বলতে চাই, বাংলাদেশ কেন, যে কোনো দেশে যেন ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য কাউকে ভয়ের মধ্যে থাকতে না হয়।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা উভয়ই চাই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেন নির্বাচন হয়। আর বাংলাদেশের পরবর্তী অধ্যায়ের পাতা খোলার ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতা করে যেতে চাই।”

কী হয়ে গেছে, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সামনের দিনে দুই দেশ একত্রে কী করতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ বলে মনে করেন রাষ্ট্রদূত গারসেটি।

ইউনূস সরকার নির্বাচনের কথা বললেও তাদের অগ্রাধিকার সংস্কারে। গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে তারা ছয়টি কমিশন গঠন করে। তার ম মধ্যে চারটি প্রতিবেদনও দিয়েছে।

ইউনূস বলছেন, সংস্কার সম্পূর্ণ করে যাওয়ার সক্ষমতা তাদের রয়েছে। তিনি ধারণা দিয়েছেন, ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের প্রথম দিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

তবে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল চায়, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিক অন্তর্বর্তী সরকার। বিএনপি বলছে, জুুলাই-আগস্টের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব।

শেখ হাসিনার শাসনকালে দিল্লি-ঢাকা সম্পর্ক যেমন নিবিড় ছিল, তেমন ছিল না ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক। বরং শেখ হাসিনা মাঝে-মধ্যেই আকারে ইঙ্গিতে যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করতেন।

কিন্তু বাংলাদেশ আফগানিস্তান হয়ে যাবে, এমন ভয় দেখিয়ে ওয়াশিংটনের কর্তাব্যক্তিদের বশে রেখেছিল ভারত। 

ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছিল, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর ওয়াশিংটন ও দিল্লির কর্মকর্তারা মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ান। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের অবস্থানে কোথাও কি কোনও ভুল ছিল?

ঢাকায় এক সময় কাজ করে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জন ড্যানিলোউইকজ ওয়াশিংয়টন পোস্টকে বলেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়কে স্বীকার করতে হবে যে বাংলাদেশ নিয়ে তারা ভুল অবস্থানে ছিল। কারণ দেশটির মানুষের চাওয়াটি তারা বুঝতে পারেনি।”

তবে কি এখন সেই ভুল দুই পক্ষ একসঙ্গে থেকে শুধরে নিতে চাইছে?

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads