বন্ধ মার্কিন সাহায্য, বিশ্বজুড়ে মানবিক সংকটের আশঙ্কা

কলম্বিয়ার কুকুটার উপকণ্ঠে টিয়েন্ডিটাস আন্তর্জাতিক সেতুর একটি গুদামে ইউএসএইডের মানবিক সহায়তার বাক্সগুলির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একজন ব্যক্তি। ছবিটি ২০১৯ সালের।
কলম্বিয়ার কুকুটার উপকণ্ঠে টিয়েন্ডিটাস আন্তর্জাতিক সেতুর একটি গুদামে ইউএসএইডের মানবিক সহায়তার বাক্সগুলির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একজন ব্যক্তি। ছবিটি ২০১৯ সালের।

যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি সাহায্য স্থগিতের ঘোষণার পর দুর্গত বিভিন্ন অঞ্চলে বন্ধ হয়ে গেছে খাদ্য বিতরণ ও  স্বাস্থ্যসেবা। এমনকি জীবন রক্ষাকারী সাহায্যও আটকে যাচ্ছে, যা বিতরণ করার নেই কোনো উপায়।

ট্রাম্প প্রশাসনের বিদেশি সাহায্য স্থগিত এবং ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএইড) সহায়তায় কাটছাঁটের ফলে উদাহরণ হিসেবে এমনটিই বলছেন সাহায্যকর্মীরা।

ইউএসএইডের এক কর্মী বলেন, “এই সহায়তা যাদের জন্য জীবন-মরণ, আমাদের মতো এমন সুবিধাভোগীদের জন্য এটা হৃদয়বিদারক।”

ইউএসএইডের আরেক কর্মী সিএনএনকে জানান, কাজ বন্ধের নির্দেশ দ্বিতীয় সপ্তাহে চলায় অংশীদারদের কাছে অস্বস্তিতে পড়ছেন তারা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

তিনি বলেন, “ইউক্রেন, মিয়ানমার, সুদানের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং জটিলতর স্থানে আমাদের কর্মসূচি রয়েছে, যেখানে বিপুল মানবিক সাহায্যের প্রয়োজন। সব বন্ধ হয়ে আছে। স্থগিত হয়ে আছে।”

ভবিষ্যতে অর্থায়ন বা চাকরি হারানোর ভয়ে সিএনএনের সঙ্গে কথা বলা এসব কর্মীদের কেউই নিজেদের নাম-পরিচয় জানাতে চাননি।

ওই কর্মী বলেন, “আমরা যে কাজ করি সেটা যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমাদের মনে হয়। আমরা ভালো লাগার জন্য এ কাজ করি না। আমরা এটা করছি কারণ এরা আমাদের অনেক কিছু দেয়, আমরা যা দিচ্ছি তারচেয়ে বেশি দেয়।

“ব্যক্তিগতভাবে এই সিদ্ধান্তকে বিধ্বংসী এবং বৈশ্বিকভাবে এটাকে অবিবেচকের মতো কাজ বলেই আমি মনে করছি।”

প্রশাসন জীবন রক্ষাকারী মানবিক সহায়তা এবং খাদ্য সহায়তার সমস্ত কর্মসূচির ছাড়পত্র জারির দাবি করলেও একাধিক কর্মী এবং ঠিকাদার সিএনএনকে জানিয়েছে, তাদের অর্থায়ন এখনও বন্ধ রয়েছে।

মাঠের অনেক কাজই অংশীদাররা করেন, পরে খরচ হওয়া টাকা ফেরত পান উল্লেখ করে ইউএসএইডের একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ওই পাওনা দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারছি না। টাকা না পেলে ছাড়পত্র মূল্যহীন।”

এদিকে সমস্ত সাহায্য সংস্থা অনাদয়ী চুক্তির কারণে সংকটে পড়ায় হাজার হাজার আমেরিকান এবং বিদেশি চাকরি হারাচ্ছেন।

সাহায্য বন্ধের ফলে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়বে এমন কিছু দেশের অবস্থা তুলে এসেছে সিএনএন এর এক প্রতিবেদনে।

নিরাপদ পানির অভাব

বিশ্বের প্রায় ৪ বিলিয়ন লোক নিরাপদ পানি বঞ্চিত। জর্ডান, ডেমোক্রেটিক কঙ্গো, ইথিওপিয়া, ভারতসহ বিশ্বের আরও অনেক দেশে নিরাপদ পানি বিষয়ক শত শত কর্মসূচিতে সহায়তা করে আসছে ইউএসএইড।

বৌল্ডারের কোলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ইভান থমাস বলেন, “এসব কর্মসূচি ছাড়া জীবজন্তু মারা যাবে; মানুষ মারা যাবে এবং বাস্তুচ্যুত হবে।”

তিনি কেনিয়ায় এ ধরনের একটি কর্মসূচিতে কাজ করেন। যেখানে ইউএসএইডের আংশিক সহায়তায় দুইশ’ ভূগর্ভস্থ গভীর পাম্প বসিয়ে ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।

এখনও ওই কর্মসূচিতে পাম্প রক্ষণাবেক্ষণ এবং সারাইয়ের জন্য চুক্তি করা লোকদের পাওনা দিতে অক্ষম।

তিনি বলেন, “এখন পুরো কর্মসূচিটিই ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।”

কেনিয়ায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সন্ত্রাসী গ্রুপ আল শাবাবের প্রভাব বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে থমাস বলেন, মানুষের কাছে যখন পানি থাকে না, তাদের গবাদিপশুগুলো মরতে থাকে; তারা তখন মানসিক চাপে পড়ে যায়। আর এ চাপের সুবিধা নিয়ে সন্ত্রাসী দলগুলো তাদের দলে ভিড়িয়ে নেয়।”

তিনি বলেন, “পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসার অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা আমেরিকাকে আরও নিরাপদ করতে পারে না।”

সেইসঙ্গে তিনি বলেন, মানুষ তৃষ্ণার্ত হয়ে মরে যাওয়ার জন্য বসে থাকবে না। তারা অন্যত্র অভিবাসনের চেষ্টা করবে। আর এরফলে বিশ্বজুড়ে অভিবাসনের চাপ আরও বাড়বে।

এছাড়া কেনিয়ার অন্যান্য স্থানে এইচআইভি/এইডস রোগীদের শুশ্রুষায় চালানো কর্মসূচিগুলোও বিঘ্নিত হচ্ছে।

বন্ধ সুদানের খাদ্যকর্মসূচি

রিফিউজিস ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট এবং ইউএসএইডের সাবেক কর্মকর্তা জেরেমি কনিনডাইক জানান, সুদানে ইউএসএইডের অর্থায়নে পরিচালিত খাবার সরবরাহের রান্নাঘরগুলো ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।

এদিকে জাতিসংঘ জানিয়েছে চলমান সহিংসতায় দেশটির বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ লোক খাদ্য সংকটে রয়েছে।

সুদান, সিরিয়া এবং গাজার এসব শরণার্থীদের ওপর এর প্রভাব বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে কনিনডিক বলেন, সাহায্য প্রত্যাহার করা হলে এসব বাস্তুচ্যুত এবং অনাহারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে; মারা না গেলেও তাদের মারাত্মক ক্ষতি হবে।”

ট্রাম্প প্রশাসনের সাহায্য স্থগিতাদেশের মধ্যে বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষ পর্যবেক্ষণকারী এফইডব্লিউএসএনইটি ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর ভলান্টিয়ারি এজেন্সিসের ডিরেক্টর জেমি মুন বলেন, “ইথিওপিয়া, সোমালিয়া এবং সুদানে মতো আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ কবলিত অঞ্চলগুলোতে জীবনরক্ষাকারী উদ্যোগগুলির একটি মূল ভিত্তি ছিল ইউএসএইড। অর্থায়ন স্থগিত হওয়ায় লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা, পরিষ্কার পানি এবং আশ্রয়নের মতো মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত হবে।”

যুক্তরাষ্ট্রে ম্যালেরিয়া প্রকোপ বাড়বে

ইউএসএইড মালিসহ আফ্রিকার ২৪টি দেশে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মূলে কাজ করছে। এর মধ্য মালিতে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর হার বেশি।

সংস্থাটি ম্যালেরিয়ানির ওষুধ, টেস্ট-কিট এবং কীটনাশক দিয়ে বানানো মশারি বিতরণ এবং সরবরাহ করে। যা ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন রক্ষা এবং মশার বংশবৃদ্ধি হ্রাসে সাহায্য করে।

ইউএসএইডের এক সাবেক ঠিকাদার বলেন, জীবন রক্ষাকারী এসব সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। আর যেসব ওষুধ কেনা হয়েছে সেগুলোর কী হবে তাও কেউ জানে না।

যারা এসব ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচিতে কাজ করতেন সবাইকে ছাঁটাই করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বিশ্বজুড়ে ম্যালেরিয়ায় বছরের প্রায় ছয় লাখ লোকের মৃত্যু হয়, যার বেশির ভাগই পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। তবে যেসব দেশে ২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইউএসএইডের মাধ্যমে ‘প্রেসিডেন্ট’স ম্যালেরিয়া ইনিশিয়েটিভ’ চালু করেন সেখানে মৃত্যুর হার অর্ধেকে নেমে এসেছেছিল।

ওই কর্মী বলেন, “আমেরিকাতে ম্যালেরিয়া নেই এর একটি কারণ হল আমরা বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়া নজরে রাখি এবং তহবিল দেই। যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”

তহবিল বন্ধ হয়ে গেলে গত বছরের ফ্লোরিডার মতো ঘটনা আরো বেশি চোখে পড়বে বলে সতর্ক করেন তিনি।

আফগানিস্তানে নারীরা অরক্ষিত

তালেবান শাসন আরও দমনমূলক এবং নিষ্ঠুর হয়ে ওঠার মধ্যে আফগানিস্তানের প্রায় দেড় লাখ অরক্ষিত নারীর নিরাপদ আশ্রয়, মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ, স্বাস্থ্য সেবা এবং পেশাগত প্রশিক্ষণের মতো জীবন রক্ষা কর্মসূচিগুলি এখন বন্ধ হয়ে গেছে বলে কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) এর আফগানিস্তানের কান্ট্রি ডিরেক্টর সিয়ও ওয়ে লি রয়টার্সকে জানান, দেশটির ৬ মিলিয়েনের বেশি লোক শুধু ‘চা এবং রুটি’ খেয়ে বেঁচে আছে।

আফগানিস্তানে ডব্লিউিএফপি প্রয়োজনের অর্ধেক তহবিলে চলছে জানিয়ে নতুন এই স্থগিতাদেশে নিয়ে উদ্বেগ জানান তিনি।

ডব্লিউএফপি গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে তহবিলের ৫৪ শতাংশ পেয়েছিল বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে।

মানবিক সহায়তার অর্ধেক যুক্তরাষ্ট্রের

যুক্তরাষ্ট্রে এই মানবিক সহযোগিতা স্থগিতাদেশের প্রভাব শুধু গুটিকয়েক দেশে নয় পুরো বিশ্বজুরে পড়বে।

ইউএসএইডের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমার মনে হয় পুরো মানবিক সহায়তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে কারণ আমরা বিশ্বের ৪০ শতাংশ তহবিল সরবরাহ করে থাকি।”

তবে জাতিসংঘের হিসেবে এ তহবিল প্রায় ৪৭ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব মানবিক সহায়তার সবচেয়ে বেশি তহবিল দাতা হলেও তা তার ফেডারেল বাজেটের এক শতাংশেরও কম।

১৯৬১ সালে কংগ্রেস ইউএসএইড প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, খাদ্য, পরিষ্কার পানি, কৃষকদের জন্য সহায়তা, নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত, শান্তি প্রচারসহ আরও অনেক কিছু দশকের পর দশক ধরে করে আসছে।

অক্সফাম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অ্যাবি ম্যাক্সম্যান এক বিবৃতিতে বলেন, “ইউএসএইড বন্ধ করে দিলে মানবিক সঙ্কটের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অর্জিত সাফল্যগুলো ধ্বংস হয়ে দীর্ঘমেয়াদি অপূরণীয় ক্ষতি ঘটাবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads