১৪ জুন, শনিবার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ২৫০তম জন্মবার্ষিকী। সঙ্গে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও ৭৯তম জন্মদিন।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি’র রাস্তায় ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সাঁজোয়া সামরিক যানের এক মহড়া চলে। ট্রাম্প একে “অবিস্মরণীয়” এক আয়োজন হিসেবে আগেই ঘোষণা করে রেখেছিলেন। তবে সমালোচকরা একে “ইগোইস্ট-ইন-চিফ” এর জন্য ব্যয়বহুল এক শ্রদ্ধাঞ্জলি বলে আখ্যায়িত করেন।
ঘণ্টাব্যাপী শোভাযাত্রা শেষে বক্তৃতা দেন ট্রাম্প। হালকা বৃষ্টির ছিটেফোঁটা সহ এক উষ্ণ সন্ধ্যায় এই অনুষ্ঠান হয়। ট্রাম্প বলেন, এমন আয়োজন অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। কারণ তার মতে, প্রতিটি দেশ তাদের বিজয় উদযাপন করে। এখন সময় এসেছে আমেরিকারও উদযাপন করার।
“আর আমরা আজ রাতেই সেটা করছি” বলেন ট্রাম্প।
শোভাযাত্রার শেষ দিকে প্রেসিডেন্টকে পরিচয় করিয়ে দেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। একমাত্র তিনিই এই দ্বৈত জন্মদিনের বিষয়টি স্বীকার করেন, অন্য কেউ না।
তিনি বলেন, “১৪ জুন হলো সেনাবাহিনীর জন্মদিন। একইসঙ্গে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টেরও জন্মদিন।” এরপর তিনি বলেন, “শুভ জন্মদিন, মি. প্রেসিডেন্ট।”
তবে সমালোচকদের মতে, এই একই তারিখে উভয় আয়োজন করা একটি অস্বস্তিকর বার্তা দেয়।

কী সেই বার্তা তা অনেকটা মেটাফোর হয়ে ধরা দিয়েছে যেন অ্যাসোসিয়েট প্রেসের ফটোসাংবাদিক জুলিয়া দেমারে নিখিনসনের তোলা একটি ছবিতে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই ছবির ফোরগ্রাউন্ডেই আছে যুক্তরাষ্ট্রের দুই সেনার উল্লসিত মুহূর্ত। আর ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে কিছুটা ঝাপসা ট্রাম্প, সঙ্গে তার কর্মকর্তারা।
শোভাযাত্রা যখন চলছিল, তখনই ওয়াশিংটন ডিসি’র লোগান সার্কেলে আনুমানিক ১০০ জন প্রতিবাদকারী বিক্ষো। করছিলেন। তাদের একজন ছিলেন ৫৫ বছর বয়সী সাবেক মেরিন সদস্য টেরি মাহোনি। তিনি এই শোভাযাত্রাকে “একনায়কতান্ত্রিক আচরণ” বলে আখ্যা দেন।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “যদি আপনি তার বাকি কাজগুলো দেখেন—যেমন সংবিধানের ওপর পা রাখা—তাহলে এই শোভাযাত্রা হয়তো শুধু বাহ্যিক চাকচিক্য। তবে এটি সবচেয়ে খারাপ ধরনের বাহ্যিকতা।”
মাহোনি জানান, তিনি ছিলেন হাজার হাজার প্রতিবাদকারীর একজন, যারা সারাদেশজুড়ে ট্রাম্পের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন।
অন্যদিকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে প্যারেড রুটের সুরক্ষিত প্রবেশপথের কাছে ছিলেন টারাস ভোরোনি। তিনি দক্ষিণ ক্যারোলিনা থেকে এসেছিলেন। তিনি এই আয়োজনে সেনাবাহিনীর প্রতি শ্রদ্ধাই দেখেছেন।
তিনি বলেন, “এটা সামরিক বাহিনীকে উদযাপন করার একটা সুযোগ। আর ট্রাম্পও এখানে থাকবেন। আমি একটু বিভ্রান্ত হয়েছিলাম যে, এটা সেনাবাহিনীর ২৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে না কি ট্রাম্পের জন্মদিনের জন্য করা হয়েছে।”
পরে তিনি নিজেই বলেন, “তাই মনে হয় এটা একসঙ্গে দুই উদযাপন।”
জন্মদিনের উৎসব
২০১৭ সালে প্যারিসে বাস্তিল দিবস উদযাপন দেখার পর থেকেই ট্রাম্প এমন একটি বিশাল সামরিক শোভাযাত্রা করতে চান। তবে তার প্রথম মেয়াদে প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের বাধার মুখে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
এবার তিনি ওয়াশিংটনে ২৮টি অ্যাব্রামস ট্যাঙ্ক, বিপুল সংখ্যক সাঁজোয়া যান, ঘোড়সওয়ার বাহিনী, সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টার আনেন—যার মধ্যে আধুনিক ও সাবেকি উভয় ধরনের যান ছিল। ১৯৯১ সালে গালফ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এটি ছিল সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়ার প্রদর্শনী।
কনিস্টিটিউশন অ্যাভিনিউর পাশে ভিড় জমে যায়। ওই রাস্তা হোয়াইট হাউজকে কংগ্রেস ভবনের সঙ্গে যুক্ত করে। এই আয়োজনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় সেনাবাহিনীর ১৭৭৫ সালের জন্ম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং তথাকথিত “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ”-এর ইতিহাস।
ট্রাম্প আসার সময় কিছু অংশে উল্লাস, আবার কিছু জায়গায় দুয়োধ্বনি শোনা যায়। ভিড়ের মধ্যে অনেকেই “মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন” (মাগা) টুপি পরেছিলেন। উপস্থিতির পরিমাণ সেনাবাহিনীর অনুমান করা ২ লাখের তুলনায় কম ছিল।
উত্তর ক্যারোলিনা থেকে আগত ৬৩ বছর বয়সী সাবেক সেনা সদস্য ফ্রেডি ডেলাক্রুজ বলেন, “সেনাবাহিনীর জন্মদিন ও ট্রাম্পের জন্মদিন আলাদা ঘটনা। এটা কাকতালীয় ব্যাপার। আমি ৬ জুন বিয়ে করেছি। ওই দিনই ছিল ‘ডি-ডে’, যখন মিত্রবাহিনী ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে নেমেছিল।”
তিনি বলেন, “এমন কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। তবে আমরা এখানে এসেছি সেনাবাহিনীকে সমর্থন করতে। আমি সেনাবাহিনীতে ৩২ বছর কাজ করেছি। আমি ট্যাঙ্ক, বিমান, হেলিকপ্টার উড়তে দেখতে চাই।”
ডেলাক্রুজ মনে করেন না, লস অ্যাঞ্জেলেসসহ বিভিন্ন শহরে অভিবাসন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (আইসিই) অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জবাবে ক্যালিফোর্নিয়ায় সেনা মোতায়েন করা ট্রাম্পের উদ্যোগ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
স্থানীয় কর্মকর্তা ও মানবাধিকার কর্মীদের মতে, এই সেনা মোতায়েন এবং এরপর ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ফেডারেল সম্পত্তি ও কর্মীদের সুরক্ষায় মেরিন সেনা পাঠানো প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার অতি ব্যবহারের এক নতুন মাত্রা।
একজন বিচারক গত বৃহস্পতিবার ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসামের করা মামলায় তার পক্ষেই রায় দেন। আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, গভর্নরের অনুমোদন ছাড়া ট্রাম্পের এই মোতায়েন অবৈধ। তবে কয়েক ঘণ্টা পর আপিল আদালত সেই রায় স্থগিত করে, ফলে সেনা মোতায়েন চালু থাকে।
ডেলাক্রুজ স্বীকার করেন, “ট্রাম্পের হাতে অনেক ক্ষমতা আছে… আমি বলতে চাই, তার আছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আর এখন সব মন্ত্রিসভা সদস্যই তাকে শতভাগ সমর্থন দিচ্ছে।”
তবে তিনি আরও বলেন, “তারপরও তিনি শুধু প্রেসিডেন্ট। তিনি কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এটা সেই সিদ্ধান্ত, যা জনগণ ভোট দিয়ে নিয়েছে।”
ফ্লোরিডার মিয়ামি থেকে আসা ৫৭ বছর বয়সী সাবেক সেনা সদস্য অ্যারন এম-ও বলেন, স্থানীয় আইন প্রয়োগে ফেডারেল বাহিনী ব্যবহারে ট্রাম্পের পদ্ধতিতে তিনি কোনও সমস্যা দেখেন না।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত ছিল ১৯৬৫ সালের পর প্রথম কোনও প্রেসিডেন্টের গভর্নরের সম্মতি ছাড়াই ন্যাশনাল গার্ড সক্রিয় করার ঘটনা। ট্রাম্প ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ ইঙ্গিত দিয়েছেন, এই মডেল সারাদেশে প্রয়োগ করা হতে পারে।
সম্প্রতি ট্রাম্প ১৮০৭ সালের ইনসারেকশন অ্যাক্ট প্রয়োগের কথাও ভেবেছেন। এই আইন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী অভ্যন্তরীণ আইন প্রয়োগে অংশ নিতে পারে। সমালোচকরা একে সামরিক শাসনের দিকে পদক্ষেপ হিসেবে দেখেন। তবে এখন পর্যন্ত ট্রাম্প তা করেননি।

সাবেক সেনা সদস্য অ্যারন বলেন, “গভর্নররা তাদের রাজ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে না পারলে ট্রাম্পের উচিত সেখানে ন্যাশনাল গার্ড পাঠানো। দেখুন, আমি নিকারাগুয়াতে জন্মেছি। আমি এখানে এসেছি ১২ বছর বয়সে। আমি জানি একজন স্বৈরশাসক কেমন। উনি কোনও স্বৈরশাসক নন।” এরপর তিনি হাত তুলে শোভাযাত্রা দেখতে থাকা ট্রাম্পকে ইঙ্গিত করেন।
‘প্রতিবাদই দেশপ্রেম’
টেক্সাসের ম্যাকঅ্যালেন থেকে আসা ২৪ বছর বয়সী আনাহি রিভাস-রদ্রিগেজ বলেন, সামরিক বাহিনীর এই জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শন ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতির সঙ্গে দেশের সামরিক শক্তির এক অস্বস্তিকর সংমিশ্রণের প্রতীক।
তিনি বলেন, “আমার জীবনে অনেক মানুষ আছে যারা ভীত। আমেরিকায় আমরা ভয় নিয়ে বাঁচি না।”
তিনি হোয়াইট হাউজের সামনে প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বলেন, “আমি এমন আমেরিকাকে সমর্থন করি না, যে দেশ পরিবারগুলোকে আলাদা করে এবং মানুষকে তাদের গায়ের রঙ বা মেক্সিকান চেহারার জন্য টার্গেট বানায়।”
চোখে জল নিয়ে তিনি বলেন, “কারণ তারা দেখতে আমার মতো।”
এর আগে সপ্তাহের শুরুতে ট্রাম্প প্রতিবাদকারীদের “দেশবিদ্বেষী” বলে অভিহিত করে বলেন, শনিবার যারা পথে নামবে, তাদের “ভয়াবহ শক্তির মুখোমুখি হতে হবে।”
রিভাস-রদ্রিগেজ এই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন, “প্রতিবাদ করাই প্রকৃত দেশপ্রেম। আমি আমার দেশের জন্য এসেছি, কারণ আমি আমেরিকাকে ভালোবাসি। হয়তো ট্রাম্পকে দেখে আমি কিছুটা আতঙ্কিত, তবে আমি ভয় পাই না। কারণ আমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছি।”
শুক্রবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটলে প্রতিবাদ চলাকালে প্রায় ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে শনিবার ওয়াশিংটনে বড় কোনও সহিংসতা বা অঘটনের খবর পাওয়া যায়নি। অনেক প্রতিবাদকারী অন্য জায়গায় বিক্ষোভ আয়োজন করে।
“নো কিংস” নামের জাতীয় পর্যায়ের বিক্ষোভ আয়োজনকারী দল ডিসিতে কোনও অনুষ্ঠান আয়োজন করেনি। তবে তারা দেশজুড়ে প্রায় ২,০০০টি শহরে কর্মসূচি পালন করে। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই এই জন্মদিনের প্যারেডকে “মহাকর্ষের কেন্দ্রবিন্দু” বানাতে চায়নি।
তবুও পুয়ের্তো রিকো থেকে আসা ৭৭ বছর বয়সী ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাবেক সেনা রোল্যান্ড রোয়েবাক এই শোভাযাত্রায় অংশ নেন প্রতিবাদ জানাতে।
তিনি বলেন, “ট্রাম্প সামরিক সেবা থেকে দূরে থেকেছেন এবং সেনাবাহিনীকে অশ্রদ্ধা করেছেন।” তিনি উল্লেখ করেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার জন্য ট্রাম্প মেডিকেল ছাড় নিয়েছিলেন, যেটি ছিল “বোন স্পারস”-এর অজুহাতে। সমালোচকরা একে সামরিক সেবা এড়ানোর কৌশল বলে মনে করেন।
রোয়েবাক বলেন, ২৫ থেকে ৪৫ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে খরচ হওয়া এই শোভাযাত্রা এমন সময় ঘটেছে যখন ট্রাম্প সরকার ভেটেরানদের জন্য সেবাসহ ফেডারেল খাতে বিভিন্ন বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। পেন্টাগনে বৈচিত্র্য, সাম্য ও অন্তর্ভুক্তি (ডিইআই) বিষয়ক নীতির বিরুদ্ধে ট্রাম্পের প্রচার তার মতো কৃষ্ণাঙ্গ সেনা সদস্যদের অবদানকে “মুছে ফেলছে”।
“অনেক মানুষ এখানে এসে বিভ্রান্ত। তারা জানে না এই শোভাযাত্রা আসলে কী বোঝাতে চায়। এটা একটি ভণ্ডামি।”, বলছিলেন রোয়েবাক।
তথ্যসূত্র : অ্যাসোসিয়েট প্রেস ও আল জাজিরা।