গত দেড় দশকে বিএনপিকে কোণঠাসা করে গোল দিয়েই গেছে আওয়ামী লীগ। জুলাই অভ্যুত্থান পাল্টে দিয়েছে সেই দৃশ্যপট। এখন রাজনীতির খেলার মাঠে আওয়ামী লীগই উধাও। কিন্তু তাতেও বিএনপির আচরণে দেখা যাচ্ছে অস্বস্তির ছাপ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট দেড় দশকের শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর হাঁফ ছাড়া বিএনপি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বোত সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এমন বলেছিলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন এই সরকারকে রক্ষা করতে হবে যে কোনোভাবে।
কিন্তু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের মতানৈক্যের মধ্যে তারেক রহমান বলে যাচ্ছেন, ষড়যন্ত্র চলছে।
বেশ কয়েকটি সভায় তিনি এমন ষড়যন্ত্রের কথা বলার পর বিএনপির ভেতরে সরকারকে নিয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাস, দূরত্ব নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে প্রতিবেদনও ছাপা হচ্ছে।
ষড়যন্ত্রের জন্য বিএনপি নেতারা প্রকাশ্য বক্তব্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কথা বললেও ভেতরে ভেতরে সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়েও কথা বলছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উদ্ভূত জাতীয় নাগরিক কমিটির নতুন দল গঠনের প্রয়াসে ওয়ান-ইলেভেনের পুরনো ষড়যন্ত্রের আভাসও পাচ্ছেন দলটির কেউ কেউ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিএনপি’র সবার বক্তব্য যদি একসাথে রাখি, বিএনপি একটা অস্থিরতায় ভুগছে দলগতভাবে। তারা শঙ্কায় ভুগছে এক-এগারোর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না?”
একা হয়ে যাওয়ার ভয়?
বিএনপির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম বিভেদ দেখা গিয়েছিল রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে। জুলাই আন্দোলনের ছাত্রনেতারা যখন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে সরানোর দাবি তোলেন, তখন তার বিরোধিতা করেছিল বিএনপি। তখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা বিএনপিকে ইঙ্গিত করে আবার বলেছিলেন, কেউ কেউ ক্ষমতা পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের এক বক্তব্য নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে বিএনপির পক্ষ থেকে। তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। তারা সংস্কারের পরিবর্তে নির্বাচনকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
তার ওই ধরনের বক্তব্য রাজনীতিবিরোধী বলে প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, সরকারের সমালোচনা করা মানে সরকারকে ব্যর্থ করা নয়।
জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়দের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি আগামী ফেব্রুয়ারিতে নতুন দল গঠনের লক্ষ্য নিয়ে প্রক্রিয়া শুরুর পর তাও ভালো চোখে দেখছে না বিএনপি।
দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রকাশ্য সমাবেশে বলেন, রাজনৈতিক দল করার অধিকার সবার আছে। তবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল হলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে।
অথচ অভ্যুত্থানের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াই আন্দোলনের নেতাদের নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
অন্তর্বর্তী সরকারকে এক সময় বিএনপি অফুরন্ত সময় দিতে চাইলেও এখন বিএনপি চাইছে, দ্রুত নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা হোক।
এক্ষেত্রে আবার সরকার কৌশলী ভূমিকা নিয়েছে। নানা সময় নানা কথা বলার পর গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস নির্বাচনের দিন-ক্ষণ নিয়ে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেন।
২০২৫ সালের শেষ কিংবা ২০২৬ সালের শুরুতে নির্বাচনের কথা বলেন তিনি। কিন্তু এরপর তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম আবার খানিকটা পিছিয়ে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেন।
এতে বিএনপি মহাসচিব তার অসন্তোষের কথা জানান; তিনি বলেন, এভাবে দুই রকম বক্তব্যে তারা বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
এখন সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইলেও অন্য দলগুলো সেভাবে এগিয়ে আসছে না। এমনকি বিএনপির এক সময়ের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীও এক্ষেত্রে দূরে সরে থাকছে।
সরকারের আচরণ দেখে মির্জা ফখরুল গত ১৯ নভেম্বরই বলেছিলেন, “সন্দেহ কিন্তু আপনাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) ওপর আসতে শুরু করেছে।”
মাস গড়িয়ে বিএনপি নেতাদের সন্দেহ এখন গাঢ় হচ্ছে। তারা মনে করছেন, নির্বাচনে যত দেরি হবে, বিএনপির নিরঙ্কুশ আসনে জয়ের সম্ভাবনা ততই কমে আসবে।
পাশাপাশি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন দল, এবং সরকারের কাছাকাছি থাকতে চাওয়া জামায়াতের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়েও রয়েছে তাদের সন্দেহ।
‘দ্রুত নির্বাচনের লড়াইয়ে একা বিএনপি’- এমন প্রতিবেদন দুদিন আগেই এসেছে দৈনিক সমকালে। একই দিন বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিএনপি’র মনোভাব কি বদলাচ্ছে?’
সমকালের প্রতিবেদনে বলা হয়- “নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কারকে গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। অভ্যুত্থানের সূত্রপাত ঘটানো ছাত্র নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের বিচারের আগে নির্বাচন হতে দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনেরও অগ্রাধিকারে রয়েছে সংস্কার। যেসব দল বিএনপির কাছ থেকে আগামী নির্বাচনে আসন ছাড় পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, তারাই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। অন্যরা দিচ্ছে না তাড়া।”
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়- “বিএনপি ন্যূনতম জরুরি সংস্কার করে নির্বাচনের পক্ষে আর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা, জামায়াত এবং বেশ কিছু রাজনৈতিক দল সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষপাতি।”
কী বলছেন বিএনপি নেতারা
বিএনপি কেন নির্বাচনের জন্য তাগাদা দিচ্ছে, তার ব্যাখ্যায় দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত বুধবার এক সভায় বলেন, “অনেকে বলেন, আমরা শুধু ভোটের কথা বলি। আমরা রাজনীতি করি। আমরা ভোটের কথা বলব, এটাই স্বাভাবিক।”
তবে দলের স্থায়ী কমিটির সভার সিদ্ধান্ত গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানানোর সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল নির্বাচন আয়োজনের তোড়জোড় না দেখে হতাশা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি দেখছি না। আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা এবার নির্বাচনের রোডম্যাপ দেবেন। তিনি তা দেননি। এটি আমাদের হতাশ করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও তার প্রেস সচিবের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। এমন বক্তব্য বিভ্রান্তি ছড়াবে। রাজনৈতিক দলগুলো সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রত্যাশা করে।”
সরকার পরিচালনায় বিএনপির মতামত না নেওয়া নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে দলটির নেতাদের মধ্যে।
তা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ডেমোক্রেটিক অর্ডারে দেশটাকে ফিরিয়ে নেওয়া এক নাম্বার প্রায়োরিটি। ১৬ বছর ধরে মানুষ রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে গণতন্ত্রের জন্য, দেশের ওপর তার মালিকানা ফিরে পাবার জন্য। যারা সেটা অনুধাবন করতে পারবেন না, সেটা তাদের সমস্যা, আমাদের সমস্যা নয়।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এখনও আশা করি, আমাদের মতামত আমলে নিয়ে তারা সঠিকভাবে দেশটা পরিচালনা করবে এবং সামনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবে।”
নির্বাচিত সরকারের গুরুত্ব তুলে ধরে তারেক রহমান বৃহস্পতিবার এক সভায় বলেন, “বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের দিকে অনেকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দুর্বল, জনসমর্থনহীন সরকার যারা জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে না, এ রকম সরকারকে যদি ক্ষমতায় রাখা যায়, তাহলে এ দেশ থেকে অনেকে অনেক কিছু লুটেপুটে নিয়ে যেতে পারবে।”
সরকারের কী ভাষ্য?
বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব ক্রমে স্পষ্ট হতে শুরু করলেও তা মনে করছেন না অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা কোনও পক্ষের সঙ্গেই অন্তর্বর্তী সরকারের বড় ধরনের কোনো মতভেদ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন না।
“রাষ্ট্র সংস্কার, নির্বাচন, বিচার এগুলো জটিল প্রক্রিয়া। এসব ক্ষেত্রে মতভিন্নতার মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটা কমিশন গঠন করা হচ্ছে।”
নির্বাচনের তাগাদা দেওয়াকে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল বলে মনে করছেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, “আস্থার সংকট হলে চিন্তিত হওয়ার ব্যাপার থাকে। কিন্তু আস্থার সংকট হয়েছে বলে মনে করি না।”
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বিএনপির আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে সম্প্রতি বলেন, এই ধরনের কথা অহেতুক বিতর্কের জন্ম দেয়। ‘মাইনাস টু’র পরিকল্পনা সরকারের নেই।
আরেক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানও সম্প্রতি বলেন, “রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যেতে উসখুস করছেন। আমিও আমার শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যেতে চাই।”
অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, তারা বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে চান না।
দ্য ইকোনমিস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসও বলেছেন, নির্বাচন দিয়ে তিনি তার কাজে ফিরে যেতে চান এবং ওই কাজই তিনি উপভোগ করেন।