অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশন যখন কাজ করেছে, রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে পৃথক সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে, তখন গণপরিষদ নির্বাচনের দাবির পেছনে ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে বিএনপি।
দলটির নীতিনির্ধারণী নেতারা মনে করছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিলম্বিত করার লক্ষ্য নিয়ে এ দাবি সামনে আনা হয়েছে। শুধু বিএনপি নয়, একই মনোভাব বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দলের। তবে জামায়াতে ইসলামী এখনও গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
এনসিপি কেন গণপরিষদ নির্বাচন চায়?
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব আশঙ্কার অবসান ঘটাতে চায়।
মঙ্গলবার এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এক অনুষ্ঠানে বলেন, “পুরোনো সংবিধান ও পুরোনো শাসনকাঠামো রেখে একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। কেবল সরকার পরিবর্তন করেই জনগণের কল্যাণ ও প্রকৃত গণতন্ত্র বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। চব্বিশের যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে, তাতে কেবল সরকার পরিবর্তন নয়; বরং শাসনকাঠামো ও সাংবিধানিক পরিবর্তন করে নতুন একটি বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করতে চাই, যেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র, ইনসাফ ও সাম্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।”
সদ্য আত্মপ্রকাশ হওয়া এনসিপি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। ইতোমধ্যে দলটিকে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ দলটিকে ‘কিংস পার্টি’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা জুলাই বিপ্লব এবং ২০২৪ এর চেতনায় একটি দেশ গড়তে চাই৷ সেজন্য আমরা সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলেছি। এজন্য সংবিধান নতুন করে প্রণয়নের দরকার৷ আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাইবো জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে৷ সেটা না হলে নির্বাচনের মাধ্যমে যদি আমরা ক্ষমতায় যেতে পারি তাহলে আমরা যা চাই তা বাস্তবায়ন করবো।”
নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীবের ব্যাখ্যা, “রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে নাগরিকেরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জনগণের রক্ষক হয়। এই পরিবর্তনগুলো করতে হলে সংবিধানে খুব র্যাডিকেল পরিবর্তন প্রয়োজন। ”
গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সন্দেহ কেন?
অন্তবর্তী সরকার সংবিধান সংস্কার কমিশন করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো এই কমিশনে তাদের পৃথক সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে। সে বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা হবে। কিন্তু হঠাৎ করে নতুন সংবিধানের কথা বলে গণপরিষদ নির্বাচনের প্রশ্ন আসায় ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছে বিএনপি।
বিএনপির নেতাদের প্রশ্ন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যার একটি সংবিধান আছে। সেই সংবিধানে শপথ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। যার প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস। সেই সরকারের বয়স সাত পার হওয়ার পর গণপরিষদের প্রয়োজন দেখা দিল কেন?
গত রোববার রাজধানীর লেডিস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “নতুন দল এসেছে, আপনারা সাবধান থাকবেন। আমি কিন্তু তাদের স্লোগান বুঝি না। আমি কিন্তু বুঝিনি কাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে। আমি এখনো বুঝিনি সেকেন্ড রিপাবলিক কী। কী বোঝায়, আপনার বুঝেছেন কি না, জানি না। অর্থাৎ একটা অসিলা ধরে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে।”
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন দেশে একটি সংবিধান আছে। সেই সংবিধানের অধীনে নতুন করে সংবিধান রচনা ও গণপরিষদ নির্বাচনের সুযোগ নেই৷ আর তারা যদি বলে সেকেন্ড রিপাবলিক, আমি তো বলব থার্ড রিপাবলিক৷ কারণ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় রিপাবলিক হয়ে গেছে৷ আর গণপরিষদ নির্বাচনের দরকার নাই। কারণ জাতীয় নির্বাচনেই ফয়সালা হতে পারে।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, “প্রথম কথা হচ্ছে গণপরিষদ কেন? সংসদ কি সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না? আর সেকেন্ড রিপাবলিকের মানে কী, তাহলে তারা কি স্বাধীনতা স্বীকার করে না? তারা হয়তো ভেবেছে, তারা যা বলবে, দেশের মানুষ তা-ই মেনে নেবে। ব্যাপারটা সে রকম নয়। আমরা তাদের এত কথার জবাব দিতে ইচ্ছুক নই। তারা যা খুশি বলুক, করুক, আমরা একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই, দেশের মানুষ নির্বাচন চায়। এটাই আমাদের কথা।”
গণপরিষদ নিয়ে অন্যদের ভাবনা
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দল এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা গণপরিষদ নির্বাচনের বিরোধীতা করছেন। শুধু ব্যতিক্রম জামায়াতে ইসলামী। গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি দলটি।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এখন জাতীয় নির্বাচন চায়৷ এখন যদি সেটা না করে তাদের দাবি মতো সরকার জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের দিকে যায় বা যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে নানা ধরনের রাজনৈতিক সংকট হবে, সংঘাত হবে৷ সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এটা রাজনৈতিক সরকার নয়। এটা একটা নির্দলীয়, নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার৷ তাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে তাদের কোনো কাজ তাদের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে৷”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গণপরিষদ মানে হলো নতুন সংবিধান করা হবে। অর্থাৎ সামনে যে নির্বাচনে হবে তাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গণপরিষদ সদস্য হিসেবে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবেন। ওই গণপরিষদই আবার পার্লামেন্ট হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য দরকার সেটি হবার কোনো সম্ভাবনা আমি নিকট ভবিষ্যতে দেখি না।”
শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমানডয়চে ভেলেকে বলেন, “এনসিপি সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন চায়, সেটার জন্য তারা গণপরিষদ নির্বাচন চান৷ এজন্য তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে৷ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে৷ কিন্তু আসলে সেটা তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়৷ এখন উপায় হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সেটা যদি হয়, তারা তাতে অংশ নিয়ে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে৷”
ড. জাহেদ উর রহমানের মতে সংবিধান, সেকেন্ড রিপাবলিকের মতো বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক দ্বিমত আছে৷ নতুন রাজনৈতিক দলটি এজন্য সরকারকে চাপ দিলে এবং সরকার তাদের দিকে ঝুঁকে পড়লে রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা দেখেন তিনি৷
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গণপরিষদ নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে করার কথা তুললেও বিষয়টি নিয়ে ভাবছে না নির্বাচন কমিশন।
মঙ্গলবার (৪ মার্চ) আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, “আমরা প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। রাজনৈতিক দলেরা তো অনেক কথাই বলে। আমরা তো ওই রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে যেতে পারব না।”
গণপরিষদ কী?
সোজা ভাবে বললে সংবিধান রচনার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত পরিষদই গণপরিষদ।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য ১৯৭২ সালের ২৩শে মার্চ বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ নামে একটি আদেশ জারি করেন। এ আদেশবলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণ গণপরিষদের সদস্য বলে পরিগণিত হন।
১৯৭২-এর জানুয়ারির ১১ তারিখ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষরিত ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২’ জারি করা হয়। এই আদেশ বলে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায় অনুসারে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবলম্বিত হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী ১৯৭২ সালের ২৩শে মার্চ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন। এবং তা ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকরী বলে ঘোষিত হয়।
এই আদেশ বলে, ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৬৯-এর (জাতীয় পরিষদে ১৬৯ জন আর প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ জন) মধ্যে ৪০৩ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। ৪০৩ জনের মধ্যে ৪০০ জন সদস্য ছিল আওয়ামী লীগের আর ১ ছিল ন্যাপের আর ২ জন ছিল নির্দলীয়।
গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১০ এপ্রিল ১৯৭২ সালে। অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। প্রথম অধিবেশনের শুরুতে শাহ আব্দুল হামিদ স্পীকার ও মোহাম্মদ উল্ল্যাহ ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন।
১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট ‘খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটি’ গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিলের এই কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
পরবর্তীতে সংবিধানের একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া প্রস্তুত করা হয়। ওই বছরের ১০ জুন খসড়া সংবিধান অনুমোদিত হয়।
১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর বাংলাদেশ গণপরিষদে সংবিধান বিল পেশ করার পর সাত দিন ধরে জাতীয় দৈনিকগুলোতে ধারাবাহিকভাবে খসড়া সংবিধানের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করা হয়।
ওই বছরের ৪ নভেম্বর ধ্বনি-ভোটে সংবিধান-বিল হিসেবে পাস হয়।
বাংলাদেশ গণপরিষদের অষ্টাদশ বৈঠক হয় ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর। আর ১৬ ডিসেম্বর রাত ১২টায় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বিলুপ্তি করা হয় গণপরিষদ।