সারা বিশ্বে হরমোনজনিত একটি নীরব বিপর্যয়ের নাম হয়ে উঠেছে থাইরয়েড রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৭০ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে থাইরয়েডজনিত সমস্যায় ভুগছেন, যার মধ্যে নারী রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। বাংলাদেশেও এই রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
প্রশ্ন হলো কী এই থাইরয়েডজনিত রোগ। মূলত এই রোগ এমন একটি অবস্থা যখন থাইরয়েড গ্রন্থি শরীরে পর্যাপ্ত হরমোন তৈরি ও নিঃসরিত করতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি সব বয়সেই হতে পারে।
আর থাইরয়েড হলো গলার সামনে অবস্থিত একটি ছোট প্রজাপতি আকৃতির গ্রন্থি। এটি থাইরোক্সিন (টি৪) ও ট্রাইয়োডোথাইরনিন (টি৩) নামক হরমোন তৈরি করে, যা আমাদের দেহের বিপাকীয় গতি নিয়ন্ত্রণ করে।
চিকিৎসাশাস্ত্রে তিন ধরনের থাইরয়েড রোগের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, প্রথমটি হাইপোথাইরয়েডিজম, যাকে ইংরেজিতে বলে আন্ডার অ্যাকটিভ থাইরয়েড, এবং দ্বিতীয়টি হাইপারথাইরয়েডিজম বা ওভার অ্যাকটিভ থাইরয়েড, এবং তৃতীয়টি হলো থাইরয়েডাইটিস।
যেহেতু থাইরয়েড গ্রন্থি হরমোন তৈরি করে তাতে বলা চলে হরমোনের ভারসাম্য হারালেই এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। যেমন থাইরয়েড গ্রন্থি যদি কম হরমোন তৈরি করে সেক্ষেত্রে হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এক্ষেত্রে প্রথমিক কিছু উপসর্গগুলো হলো:
- অতিরিক্ত ক্লান্তি
- ওজন বৃদ্ধি
- ঠান্ডা সহ্য না হওয়া
- মানসিক অবসাদ
- ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া
আবার থাইরয়েড গ্রন্থি যদি অতিরিক্ত হরমোন তৈরি করতে থাকে তাতেও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যার কারণে হাইপারথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত হতে পারেন যে কেউ। এর উপসর্গগুলো হলো:
- হঠাৎ ওজন হ্রাস
- দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ
- দ্রুত হৃদস্পন্দন
- অতিরিক্ত ঘাম
- ঘুমে সমস্যা
থাইরয়েড গ্রন্থিতে প্রদাহ হলে তৃতীয় ধরনের থাইরয়েড রোগ অর্থ্যাৎ থাইরয়েডাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটি ধীরে ধীরে বা হঠাৎ করেই হতে পারে। এই রোগে প্রথমে অপ্রয়োজনীয় হরমোন বের হয় (থাইরোটক্সিক ধাপ), পরে হরমোন কমে যায় (হাইপোথাইরয়েড ধাপ), মাঝে মাঝে স্বাভাবিক।
থাইরয়েড নিয়ে আমরা কথা বলেছি ফিনল্যান্ডের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইয়ান্নে কসকেলার সঙ্গে।
তিনি বলেছেন, থাইরয়েড রোগে একবার আক্রান্ত হলে তা থেকে মুক্তি না মিললেও সঠিক পরিমাণে এবং নিয়মিত ওষুধ সেবন করলে তা খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সূতরাং ভয়ের কিছু নেই। তবে নিয়মিত মাত্রা পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে অবশ্যই।
“রক্ত পরীক্ষা যেমন, টিএসএইচ, টি৩, টি৪ ও অ্যান্টিবডি (যেমন: টিএসআই, অ্যান্টি-টিপিও) পর্যবেক্ষণ করতে হবে নিয়মিত। অবশ্য ইমেজিংয়ের মাধ্যমেও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে আল্ট্রাসাউন্ড বা স্ক্যান করা হয়।”
জানতে চেয়েছিলাম এই রোগের ঝুঁকি কাদের বেশি। জবাবে তিনি জানিয়েছেন, যেকোনো বয়সভেদে এই রোগে যেকেউ আক্রান্ত হতে পারে। তবে যাদের পরিবারে এ ধরনের রোগী রয়েছে তাদের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। তার কারণ হলো, অধিকাংশ থাইরয়েড রোগই জিনগত (genetic) অথবা অটোইমিউন (autoimmune) সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা আপনি প্রতিরোধ করতে পারেন না।
তবে দুটি অবস্থাকে কিছুটা প্রতিরোধ করা সম্ভব, যেমন আয়োডিনের মাত্রা বেড়ে গেলে বা ঘাটতির কারণে সৃষ্ট থাইরয়েড সমস্যা।
“আপনার আয়োডিন গ্রহণ সঠিক পরিমাণে হচ্ছে কি না, তা নিয়ে চিন্তিত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ করুন।”
থাইরয়েডের চিকিৎসা কী?
ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন চিকিৎসা রয়েছে। যেমন হাইপোথাইরয়েডিজমের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাত্রায় অ্যান্টি থাইরয়েড ওষুধ সেবন করতে হয়।
কারো যদি হাইপারথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোন বেশি) থাকে, তাহলে চিকিৎসার কিছু বিকল্প হলো:
১. অ্যান্টিথাইরয়েড ওষুধ (যেমন মেথিমাজল ও প্রপাইলথাইউরাসিল): এসব ওষুধ থাইরয়েড গ্রন্থিকে অতিরিক্ত হরমোন তৈরি করা থেকে বাধা দেয়।
২. রেডিওআয়োডিন (রেডিওধারিত আয়োডিন) থেরাপি: এই চিকিৎসায় থাইরয়েড কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, যাতে তা অতিরিক্ত হরমোন তৈরি না করতে পারে।
৩. বেটা-ব্লকার ওষুধ: এগুলো সরাসরি থাইরয়েড হরমোনের ওপর কাজ করে না, তবে হূদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া বা উদ্বেগের মতো উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
৪. সার্জারি: স্থায়ী চিকিৎসার জন্য থাইরয়েড গ্রন্থি অপসারণ (থাইরয়েডেকটমি) করার পরামর্শ দিতে পারেন চিকিৎসক। এতে হরমোন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। তবে সারাজীবন আপনাকে কৃত্রিম থাইরয়েড হরমোন (ট্যাবলেট আকারে) খেতে হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আন্নে কসকেলা পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, থাইরয়েড কঠিন কোনো রোগ নয়, ভয়েরও কিছু নেই। তবে সঠিক চিকিৎসা না করালে স্বাভাবিক জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে উপযুক্ত পরীক্ষা ও চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ জীবন যাপন করা সম্ভব।
এ সংক্রান্ত আরও খবর: