ক’দিন আগে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী দাবি করেছিলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সদস্যরা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। শুধু তাই নয়, তারা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী শিলিগুঁড়ি করিডরের কাছেও গিয়েছিল। বলেছিলেন, বাংলাদেশে মৌলবাদীদের উত্থান ঘটেছে।
আর ওমানের মাস্কাটে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তো বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনকে জানিয়েই দেন, সন্ত্রাসবাদের স্বাভাবিকীকরণ করাটা বাংলাদেশের উচিত নয়।
এরপরই পশ্চিমবঙ্গে গোপনে সফর করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল।
ভারতের এসব পদক্ষেপে বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানি গোয়েন্দা আর সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ তুলে কী করতে চলেছে ভারত? গোপনে পশ্চিমবঙ্গে এসে দু’দিন ধরে কী পরিকল্পনা করলেন ভারতের ‘জেমস বন্ড’ নামে পরিচিতি অজিত দোভাল?
মূলত ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পারদ নামতে থাকে নিচের দিকে। বাংলাদেশে ক্রমাগত ভারতবিরোধী মন্তব্য, সেভেন সিস্টার ও কলকাতা দখলের হুমকি, ভারতীয় পণ্য বয়কট, ভারতীয় পতাকা অবমনার ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে।
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেশটিতেই আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া দেশটিতে আত্মগোপনে আওয়ামী লীগের হাজারো নেতাকর্মী।
হঠাৎ করে বাংলাদেশের এই ভারতবিরোধিতা নিয়ে সরকারিভাবে এতোদিন উচ্চবাচ্য না করলেও ভারত যে থেমে নেই সে ইঙ্গিত মেলে দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীর মন্তব্যে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআইয়ের সাংবাকিদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সদস্যরা যদি বাংলাদেশে সফর করে থাকে, তবে সেটা ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয়। কারণ, বাংলাদেশের ওই মাটি ব্যবহার করে ভারতে সন্ত্রাসীদের পাঠানোর সুযোগ থাকা উচিত নয়।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশ সন্ত্রাসীদের সুযোগ দিচ্ছে- ভারতীয় সেনাপ্রধান এমনটি বোঝাতে চেয়েছেন কিনা তা বিশ্লেষণের বিষয়। তবে এটি পরিষ্কার, এরকম অভিযোগের প্রেক্ষিতেই পাকিস্তানে সার্জিকাল স্ট্রাইক এবং এয়ার স্ট্রাইক চালিয়েছিল দেশটি।
মাস্কাটে এস জয়শঙ্কর ও তৌহিদ হোসেনের বৈঠকেও এরকম ইঙ্গিত দিয়েছে ভারত।
সেখানে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দেন, সন্ত্রাসবাদের স্বাভাবিকীকরণ করাটা বাংলাদেশের উচিত নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশে যে মৌলবাদী শক্তি মাথা চাড়া দিয়েছে, সন্ত্রাসীরা অবাধে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে তাতে যে ভারত উদ্বিগ্ন সেটিই স্পষ্ট করেছেন এস জয়শঙ্কর।
ভারত যে শুধু উদ্বিগ্নই নয়, প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে তা স্পষ্ট হয়েছে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের কলকাতায় দু’দিন অবস্থানের মধ্য দিয়ে।
এই অজিত দোভাল বহু বছর ধরে আন্ডারকভার এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। পাকিস্তানের মাটিতে ঘাঁটিগাড়া ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদীদের আয়ের উৎস, তাদের ঘাঁটিগুলোর অবস্থান, অস্ত্র ও রসদ যাওয়া আসার পদ্ধতি এবং পরমাণু অস্ত্র সংক্রান্ত গুরুত্বপুর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।
ভারতবিরোধী আন্দোলন মাথা চাড়া দেওয়ায় ১৯৯০ সালে কাশ্মীরে গিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রধান ইখওয়ান-ই-মুসলিমিন দলের প্রতিষ্ঠাতা কুকা পারে-কে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে এনেছিলেন অজিত।
মিজোরামে মিজো বিদ্রোহ সমাধানসহ অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন নিজ পরিকল্পনায়।
২০১৬ সালে পাকিস্তানে সার্জিকাল স্ট্রাইক এবং ২০২৪ সালে পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়ার বালাকোট ক্যাম্পে যে এয়ার স্ট্রাইক চালানো হয়েছিল তারও ‘মাস্টার প্ল্যান’ করেছিলেন অজিত দোভাল। তাই ভারতের মানুষের কাছে তিনি ‘জেমস বন্ড’ হিসেবে পরিচিতি।
সেই অজিত দোভাল গোপনে গত ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদিন কলকাতায় অবস্থান করেন। আর ২২ ফেব্রুয়ারি ভারতের ২৮টি কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থার কমন প্লাটফর্ম মাল্টি এজেন্সি সেন্টারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ইস্যুতে নিজের প্ল্যান অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছেন অজিত। বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের উত্থান এবং পশ্চিমবঙ্গ এবং সেভেন সিস্টারের রাজ্যগুলোতে জঙ্গিরা অবস্থান করছে- এই আওয়াজ তুলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে ভারত। এজন্য বাংলাদেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিদের উত্থান বিষয়টি সামনে আনছে দেশটি।
গত ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে চিহ্নিত জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা জেলখানা থেকে মুক্ত হয়েছে, মাজার ভাঙচুর, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ, বাউলদের উপর হামলা এবং হিন্দুদের নির্যাতনের বিষয়গুলো একে একে সামনে আনতে শুরু করেছে তারা।
এছাড়া ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিয়ে ‘বাংলাদেশ যে পূর্ব পাকিস্তানের দিকে ফিরে যেতে চায়’- এমনটি প্রমাণ করার চেষ্টা করছে ভারতীয় গোয়েন্দারা।
বাংলাদেশে সম্প্রাতিক হামলা এবং অন্তবর্তী সরকারের এসব বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভারতের পালে হাওয়া লেগেছে। বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের নামও ধীরে ধীরে জঙ্গিরাষ্ট্র হিসেবে প্রচারিত হতে শুরু করেছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে তো নিয়মিতই আসছে এসব খবর; আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায়ও আসতে শুরু করেছে। আর এটি প্রমাণ করা গেলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও ভারতের জন্য সহজ হবে।
ভারতীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে ভালো জানাশোনা আছে এমন একটি সূত্র জানিয়েছে, যে মাস্টার প্ল্যান নিয়ে ভারত এগোচ্ছে তা বাস্তবায়ন করা হলে, কোন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, বা কীভাবে প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করা হবে তা দেখতে পশ্চিবমঙ্গে অজিত দোভাল সফর করেন।
ভারতীয় সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মনোজ দাস বলেন, “৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে মৌলবাদ গোষ্ঠীর উত্থানে ভারত উদ্বিগ্ন। জঙ্গিরা বাংলাদেশের কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ করছে। জঙ্গিরা ভারতে নাশকতার পরিকল্পনা করছে বলে খবর আছে গোয়েন্দাদের কাছে। আর তাদের পেছনে রয়েছে পাকিস্তান। তাই ভারতীয় গোয়েন্দাদের সতর্ক করা এবং পরিস্থিতি মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিতেই অজিত দোভাল কলকাতায় এসেছিলেন।”
বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান মনে করেন, মাজারে হামলা; লালন মেলা বন্ধ, বাউলদের উপর হামলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়ার মতো ঘটনা গত কিছুদিনে ঘটেছে। বইমেলায় হামলা, অভিনেত্রীদের শোরুম উদ্বোধনে বাধা এমনকি মেয়েদের ফুটবল খেলতে দেওয়া হয়নি। এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে বর্তমানে।
এসব ঘটনা ইসলামি জিহাদি গ্রুপগুলো করেছে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
জাহেদ বলেন, মৌলবাদ মাথা চাড়া দিলে বাংলাদেশকে ইউরোপও পছন্দ করবে না, ভারত তো নয়ই। ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন মিছিলে আইএসের পতাকা বহন করা হয়েছে। এসব ঘটনা সামনে এনে ভারত বলতে চাইছে তারা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে।
“যদিও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মৌলবাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি, যার সুযোগ নিচ্ছে ভারত,” যোগ করেন তিনি।