বাংলাদেশে সত্তরোর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্থার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যিনি একাত্তরে দেশটির স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ; সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়েছেন সরব। খবরের কাগজেও প্রকাশিত হয়েছে সচিত্র প্রতিবেদন।
আবদুল হাই ওরফে কানু (৭৮) নামে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা শাখার সাবেক সহসভাপতি।
অবশ্য বিগত আট বছরে তিনি এলাকায় যেতে পারেননি আওয়ামী লীগেরই রোষানলে পড়ে।
রোববার দুপুরে উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ওই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানোর ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
১ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, দুজন ব্যক্তি জুতার মালা পরা অবস্থায় ওই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে টানাহেঁচড়া করছেন। তাকে লাঞ্ছিত করা ব্যক্তিদের একজনই পুরো ঘটনার ভিডিও ধারণ করেন। এ সময় বারবার ছেড়ে দেওয়ার আকুতি জানাতে দেখা গেছে ওই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে।
বিবিসি বাংলা লিখেছে, হেনস্তার শিকার হয়ে ওই মুক্তিযোদ্ধা বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। লুদিয়ারা গ্রামের এই বাসিন্দা পাশের জেলা ফেনীতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে সকাল সন্ধ্যার খবর।
পত্রিকাটি পরিবারের সদস্যদের উদ্ধৃত করে লিখেছে, স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা আবদুল হাইকে লাঞ্ছিত করে এলাকা ছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন।
প্রথম আলো এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির মাহফুজুর রহমানের বক্তব্য তুলে ধরে।
সেখানে অবশ্য মাহফুজ জানান, জামায়াত ও শিবিরের কোনো নেতাকর্মী এই ঘটনায় জড়িত থাকলে তারা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন।
বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদ থেকে একটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, আবদুল হাই বিগত সরকারের আমলেও ছিলেন নির্যাতনের শিকার। চৌদ্দগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের পক্ষে রাজনীতি না করায় গত প্রায় আট বছর এলাকাছাড়া ছিলেন তিনি। তার বাড়িঘরে একাধিকবার হামলা হয়েছে বলেও খবরে প্রকাশ।
এ ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের প্রেস উইং থেকে বিবৃতি প্রকাশের খবর দিয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তর।
যাতে বলা হয়, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য হেনস্থার শিকার আবদুল হাইয়ের ছেলে গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া অভিযোগ করেছেন, ঘটনার পর থেকে চৌদ্দগ্রাম থানার ওসির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনো সাড়া পাননি।
সোমবার যমুনা টেলিভিশনসহ গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন আবদুল হাই কানু।
তিনি বলেন, “গতকালের ঘটনায় কারা জড়িত তাদের নাম আমি জানি। কালকের ঘটনায় সরাসরি জামায়াত শিবিরের ক্যাডার কুলিয়ারা উত্তর পাড়ার মোহাম্মদ আবুল হাশেম মজুমদার এবং ওহিদুর রহমানসহ ১০ থেকে ১৫ জন ছিলেন।”
এ সময় সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন আবদুল হাই।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
আবদুল হাই কানুকে লাঞ্ছনার ঘটনায় প্রতিক্রিয়ায় সয়লাব হয়ে গেছে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যম। তীব্র প্রতিবাদ যেমন এসেছে, তেমনি কেউ কেউ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দুষেছেন বিগত সময়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতনের জন্য।
হালিম সুমন নামে একজন লিখেছেন, “এরা তো আগেই বলেছে- একাত্তর অতীত। মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পরানোটা তাই এদের কাছে খুব স্বাভাবিক।”
আলামিন অর্নব নামে আরেকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, “বিজয়ের মাসে বীর মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা এ যেন ৭১ এ পরাজিত হওয়ার জ্বালা।
ভিডিওটির বর্ণনা করে তিনি লিখেছেন, “দৃশ্যটা দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এই মানুষগুলোর জন্যই আজকের বাংলাদেশ। তাদেরকে অপমান করা মানে বাংলাদেশকে অপমান করা। নব্য বিপ্লবীদের এই আচরণ জাতি মনে রাখবে।”
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী শাহ মাহবুব রাজি লিখেছেন, “বিজয়ের মাসে রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা! এই জুতার মালা (এক জনের নাম) গলাতেও ঝুলায়ে দেয়া হবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”
আনিসুর রহমান, যিনি কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের একজন প্রথম সারির নেতা, ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, “আবদুল হাই কানু ভাই আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময় এলাকায় যেতে পারেননি। ভেবেছিলেন এখন তো মুজিবুল হক নেই, সমস্যা হবে না। কিন্তু তিনি জানতেন না, জামাতের নেতারা প্রকৃত আওয়ামী লীগ চিনতে ভুল করে না। প্রকৃত আওয়ামী লীগ চিনতে ভুল করে আওয়ামী লীগ।”