পুতিনের বহু গোপন মিশনের কারিগর, কে এই  গুপ্তচর ‘দ্য ব্যারন’

Besida

রিয়াদের রিটজ-কার্লটন হোটেলটি গত মাসে এক প্রকার লকডাউনেই ছিল। দেশি-বিদেশি কারও জন্য বিলাসবহুল ওই হোটেলের দরজা খোলা ছিল না। কারণ সেখানে ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গোপন আলোচনা চলছিল। 

আলোচনা শেষে এক পর্যায়ে হোটেলের কনফারেন্স রুমের দুটো কাঠের দরজা খুলে যায়। সেখান থেকে সবার সামনে বেরিয়ে আসেন রাশিয়ার এক গুপ্তচর জেনারেল। তিনি ক্রেমলিনের পক্ষে ওই আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

ওই গুপ্তচর হলেন কর্নেল জেনারেল সের্গেই বেসেদা। বৈঠক থেকে বের হয়ে তিনি দ্রুত এগিয়ে এলেন। কিন্তু ক্যামেরার ফ্ল্যাশ দেখতে পেয়ে একটু অস্বস্তি নিয়ে থমকে গিয়ে কেটে পড়ার জন্য হয়তো ঠোঁটে ঝুলিয়ে দিলেন হালকা হাসি। 

রাশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী গোয়েন্দাদের একজন তিনি। প্রকাশ্যে তাকে খুব কমই দেখা যায়। বহু বছর ধরে তিনি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সবচেয়ে গোপন মিশনগুলো পরিচালনা করছেন। ইউক্রেন ইস্যুতে এবার তিনি জনসম্মুখে এলেন।

২০২৪ সালের এই সময়ে, তিনি তার স্বাভাবিক গোপন কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তাকে “দ্য ব্যারন” নামে চেনে। তিনি প্রায়ই ছদ্মনামে হোটেল বুক করে সিআইএ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করতেন। তাদের আলোচনার বিষয় ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বন্দি বিনিময়। 

এই বিনিময়টি গত ১ আগস্টে হয়েছিল। এর ফলে ২৪ জন বন্দি মুক্তি পান। তাদের মধ্যে ছিলেন ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর সাংবাদিক ইভান গারশকোভিচ।

তখন বাইডেন প্রশাসন ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’কে সতর্ক করে বলেছিল, বেসেদার নাম প্রকাশ্যে আসলে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার যে সীমিত পথ খোলা আছে, তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে আমেরিকান বন্দিদের মুক্তির আলোচনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত।

কর্নেল জেনারেল সের্গেই বেসেদা।

এই বছর ৭০ বছর বয়সী এই অভিজ্ঞ গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবার সেই হোটেলগুলোতেই আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। এবার তার দায়িত্ব ইউক্রেন ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শান্তি আলোচনা পরিচালনা করা। এই আলোচনা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গত শুক্রবার মস্কো পৌঁছেছেন পুতিনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা এগিয়ে নিতে।

বেসেদার এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়া প্রমাণ করে, এখন পুতিনের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোই পররাষ্ট্রনীতির আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন ঘটনা শীতল যুদ্ধের সময়েও দেখা যায়নি।

বেসেদার সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন যেসব গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও কূটনীতিক, তারা বলেন—ইউক্রেনে অভিযানের পরিকল্পনায় জড়িত এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার আলোচনায় অংশগ্রহণ কিয়েভের প্রতি একটি বার্তা। তা হলো—পুতিন এখনো ইউক্রেনের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অর্জনের লক্ষ্যেই কাজ করছেন। তবে ইউক্রেন এবং বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ এই লক্ষ্যকে কখনোই গ্রহণযোগ্য মনে করে না।

কিয়েভ অভিযোগ করেছে, যুদ্ধ শুরুর আগেই বেসেদার নেতৃত্বে রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) ইউক্রেনের জনমত জরিপ পরিচালনা করেছিল। এই জরিপগুলো রাশিয়ার অভিযান পরিকল্পনাকে উস্কে দিয়েছিল। 

এরও আগে ২০১৪ সালে যখন কিয়েভে রুশপন্থী প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করা হয়, তখন ইউক্রেনের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন—বেসেদা এমন এক অভিযানে জড়িত ছিলেন যার পরিণতিতে বহু পশ্চিমাপন্থী আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হন। যদিও তখন ক্রেমলিন দাবি করেছিল, বেসেদা শুধু রুশ দূতাবাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়েছিলেন।

২০২৩ সালে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল কিরিলো বুদানভকে এক সাক্ষাৎকারে যখন প্রশ্ন করা হয়, “সবচেয়ে বিপজ্জনক রুশ কে?” — তখন তিনি প্রথমে চুপ ছিলেন। পরে তিনি বলেন, “বেসেদা। তিনি ইউক্রেনের অনেক ক্ষতি করেছেন।”

‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ পত্রিকাটি বেসেদার পেশাগত জীবনের প্রোফাইল তৈরি করতে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান ও সাবেক কূটনীতিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বেসেদার সঙ্গে কাজ করেছেন। এছাড়া পত্রিকাটি বিমানযাত্রার তালিকা ও কিছু অপ্রকাশিত ছবি পর্যালোচনা করেছে, যেখানে দেখা যায় বেসেদা গোপন আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বেসেদা ১৯৭০-এর দশকে কেজিবিতে যোগ দেন, পুতিনের ঠিক কিছু সময় পর। তিনি এখন রাশিয়ার গুটিকয়েক কর্মকর্তার একজন, যাদের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আছে। পশ্চিমা বিশ্বে তার সম্পর্কে খুব কম তথ্য রয়েছে—বিশেষ করে সাধারণ মানুষের কাছে। তবে গোয়েন্দা বিশ্লেষক ও ক্রেমলিন বিশেষজ্ঞরা জানেন, তিনি রাশিয়ার সবচেয়ে গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে বড় ভূমিকা রেখেছেন।

সাধারণ আর্জেন্টাইন সেজে কাজ করার সময় দুই রুশ গুপ্তচরকে গ্রেপ্তার করেছিল স্লোভেনিয়া। তখন বেসেদা পাশের দেশ সার্বিয়ায় যান। বিষয়টি নিয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করেন। কারণ এটি পুতিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। 

বেসেদা সেখানে স্থানীয় গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে দেখা করেন। কথোপকথনের সময় তিনি অল্প কিছু ইতালিয়ান ভাষা ও কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর অধীনে কাজ করার সময় শেখা স্প্যানিশ ব্যবহার করেন। তিনি অনুরোধ করেন, বন্দি সেই দম্পতি ও তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তানদের যেন যত্ন নেওয়া হয়। পরে তাদের একটি প্রশস্ত ভিলায় রাখা হয় এবং প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে ভিডিওকলে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়।

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের রিটজ কার্লটন হোটেল। এখানেই ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার গোপন বৈঠক হয়।

এর আগে সৌদি আরবের রিয়াদে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শান্তি আলোচনার যেই পর্ব হয়েছিল, তার চেয়ে এবারের বৈঠক ছিল আরও গোপনীয়। বেসেদা যখন উপস্থিত ছিলেন, তখন হোটেলের ভেতরে কোনো সংবাদমাধ্যমকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কোনো মন্তব্যও দেওয়া হয়নি বৈঠকের দিন। 

পরদিন হঠাৎ করেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা কৃষ্ণ সাগরে যুদ্ধবিরতির শর্ত মানবে না, যদি না তাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। কৃষ্ণ সাগর সংক্রান্ত এই আলোচনাই ছিল বৈঠকের মূল বিষয়।

এই বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে সিআইএ, এফবিআই ও হোয়াইট হাউস। এমনকি ক্রেমলিন ও এফএসবিও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

আলোচনার জন্য বেছে নেওয়া হোটেলটি ছিল রাজপ্রাসাদের মতো। এর হলরুমগুলো সুশোভিত ছিল রঙিন পাথরের মোজাইকে। ২০১৭ সালে এই হোটেলেই সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান শত শত রাজপুত্র, মন্ত্রী ও ব্যবসায়ীকে আটকে রাখেন এবং দুর্নীতির অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। একই শহরে বেসেদা আগস্ট মাসের বন্দি বিনিময়ের চূড়ান্ত আলোচনা করেন। 

ওই আলোচনায় অংশ নেয় সিআইএর ডেপুটি ডিরেক্টর অব অপারেশনস টম সিলভেস্টারের নেতৃত্বাধীন একটি দল এবং জার্মানির গোয়েন্দা সংস্থা বিএনডি’র প্রতিনিধি দল। ওই আলোচনা থেকেই তৈরি হয়েছিল সেই “বড় তালিকা”—যেখান থেকে বন্দি বিনিময় হয়েছিল তুরস্কের আঙ্কারায় একটি সুরক্ষিত বিমানবন্দরে।

মানুষ হিসেবে বেসেদা প্রাণবন্ত ও রসিক। তিনি রাশিয়ার সাধারণ কঠোর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের চেয়ে অনেক উষ্ণ ব্যবহার করেন। সিআইএর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে তিনি উপহার হিসেবে নিয়ে আসেন সোভিয়েত ইতিহাসভিত্তিক কিছু স্মারক। এর উত্তরে সিআইএ তাকে উপহার দেয় এক বোতল বার্বন হুইস্কি।

‘দ্য ব্যারন’

বাইডেন প্রশাসনের সময় ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের কারণে ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। পরিস্থিতি ছিল ১৯৬২ সালের কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কটের পর সবচেয়ে খারাপ। তখন উভয় দেশই নিজেদের গোয়েন্দা সংস্থার ওপর নির্ভর করেছিল যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়ার জন্য। 

সেই সঙ্কটকালে বেসেদা ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন রুশ কর্মকর্তার একজন, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কখনও কখনও তাকে সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম বার্নসের সঙ্গেও বৈঠকে পাঠানো হতো।

ওবামা প্রশাসনের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে উষ্ণ ছিল। তখন মস্কোতে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হতো “স্পাই বল” নামে একটি নববর্ষের অনুষ্ঠান। বেসেদা সেখানে ছিলেন একজন আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত অতিথি। 

রুশ গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ভদকা পরিবেশিত হতো। আর সেখানে সিআইএ, এফবিআই, কিউবা, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দা কর্মকর্তারা একসঙ্গে জড়ো হতেন। যদিও তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল বেশ অস্বস্তিকর।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইকেল ম্যাকফল এই অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে বলেন, “বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে আসা বিচিত্র লোকজন এখানে থাকতেন। আমরা সেখানে নিজেকে অনেকটাই ‘জলের মাছ’ মনে করতাম।”

বেসেদাকে সিআইএ’র দেওয়া কোডনাম ছিল “দ্য ব্যারন।” এই নামটি এসেছে তার দামি পোশাক পরার অভ্যাস ও হাভানায় কাটানো সময় থেকে গড়ে ওঠা সিগার প্রীতির কারণে। 

যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, “বন্দি বিনিময় নিয়ে আলোচনার জন্য ক্রেমলিন বেসেদাকে নিয়োগ দিয়েছিল। এসব বিষয় এফএসবি খুব সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।”

তুরস্কের আঙ্কারা বিমানবন্দরে গোপনে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বন্দি বিনিময়ের দৃশ্য।

বেসেদার সিআইএর সঙ্গে গোপন বৈঠকগুলো হতো ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন হোটেলের কনফারেন্স রুমে। এসব বৈঠকে ফোন নিষিদ্ধ ছিল। গোপন আলোচনা থেকেই ২০২২ সালে বন্দি বিনিময় সম্ভব হয়। এতে রাশিয়ায় আটক থাকা যুক্তরাষ্ট্রের দুই নাগরিক—অলিম্পিক স্বর্ণপদকজয়ী বাস্কেটবল খেলোয়াড় ব্রিটনি গ্রাইনার ও সাবেক মেরিন ট্রেভর রিডকে মুক্তি দেওয়া হয়। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র মুক্তি দেয় রুশ অস্ত্র ব্যবসায়ী ভিক্টর বাউট ও মাদকপাচারকারী কনস্টানটিন ইয়ারোশেঙ্ককে।

তবে এই দুই আমেরিকান ছিলেন সাধারণ অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত। বিপরীতে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর সাংবাদিক ইভান গারশকোভিচ ও সাবেক মেরিন পল হুইলানকে আটক করা হয়েছিল গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে। অবশ্য এই অভিযোগ তারা, তাদের পরিবার ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার অস্বীকার করেছে। 

এই ধরনের মামলায় অগ্রগতি অনেক কঠিন। এসব ক্ষেত্রে বেসেদার অবস্থান বেশ কঠোর। শুরুতে তিনি জোর দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘গুপ্তচরের বিনিময়ে গুপ্তচর’ দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের ওপর নজরদারি

বেসেদার হাতেগোনা কয়েকটি ছবি জনসমক্ষে এসেছে। একটি ছবিতে দেখা যায়, তিনি গম্ভীর মুখে নিজের অফিসে বসে আছেন। তার পাশেই রয়েছে একগুচ্ছ সাদা রঙের ভার্টুশকা ফোন। এই ডায়ালবিহীন ল্যান্ডলাইন ফোনগুলো সোভিয়েত আমলে ব্যবহার করা হতো ক্রেমলিনের সঙ্গে নিরাপদ যোগাযোগের জন্য। তবে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বেসেদার নাম নেই সংস্থার শীর্ষ নেতৃত্বের তালিকায়।

তিনি প্রায় কখনোই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম ২০১২ সালে। সেবার তিনি এফএসবির নিজস্ব ম্যাগাজিনে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি বলেন, রাশিয়ার উচিত বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা আরও জোরদার করা। তার কথায়, “প্রত্যেক সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ জানে, আপনি এই পৃথিবীতে একা টিকে থাকতে পারবেন না।”

বেসেদার উত্থান শুরু হয় আরও প্রায় ৪০ বছর আগে, আরেকটি গোপন যোগাযোগ চ্যানেলের মাধ্যমে। ১৯৮০-এর দশকে তরুণ এক কর্মকর্তা হিসেবে তিনি কাজ করতেন কেজিবির দ্বিতীয় বিভাগে, বিশেষ করে “আমেরিকান সেকশন”-এ। এই বিভাগে তার দায়িত্ব ছিল মস্কোতে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ওপর নজরদারি করা। সেখান থেকেই সিআইএর সঙ্গে একটি গোপন যোগাযোগের পথ তৈরি হয়।

লুবিয়াঙ্কায় (এফএসবির প্রধান কার্যালয়) বেসেদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা তাকে অভিহিত করেন “বর্বর নিয়ন্ত্রক” হিসেবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, এফএসবির কোনো কর্মকর্তা অতিরিক্ত সক্রিয় বা কঠোর হয়ে উঠলে বেসেদার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে নিয়ন্ত্রণে আনার অনুরোধ জানানো হতো।

গত বছর থেকে বেসেদা এফএসবি পরিচালক আলেকজান্ডার বোর্তনিকভের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। এর আগে তিনি সংস্থার “ফিফথ সার্ভিস” পরিচালনা করতেন। এই ইউনিটটি বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থার সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান দেখভাল করে। এর অন্তর্ভুক্ত “অপারেটিভ ইনফরমেশন বিভাগ”—যা এফএসবির বিদেশি গোয়েন্দা শাখা হিসেবে পরিচিত। 

যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক রুশ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মতে, ইউক্রেন অভিযানের পরিকল্পনা মূলত এই বিভাগ থেকেই তৈরি হয়েছিল।

রাশিয়ান অনুসন্ধানমূলক ওয়েবসাইট আজেন্তুরার তথ্যমতে, এক সময় বেসেদা এফএসবির অতি-গোপনীয় ডিকেআরও ইউনিটে কাজ করতেন। এই ইউনিটই ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সাংবাদিক ইভান গারশকোভিচসহ যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন নাগরিককে গ্রেপ্তারের জন্য দায়ী বলে আজেন্তুরার একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বেসেদাকে প্রেসিডেন্ট প্রশাসন তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগে স্থানান্তর করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্দি বিনিময় আলোচনা থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ও তার ডেপুটি সের্গেই রিয়াবকভ প্রায় পুরোপুরি বাদ পড়েছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায়, বন্দি বিনিময় ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগে বেসেদার প্রভাব ও অবস্থান কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

“আমি সবকিছু নিজেই জেনে নিতে পারি”

বন্দি বিনিময় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার গোপন যোগাযোগ চ্যানেলটি স্পষ্টভাবে গঠিত হয় ২০২১ সালের জুন মাসে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় একটি হ্রদের ধারে ১৮শ শতাব্দীর একটি ভিলায় শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন।

ওই বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূত জন সুলিভানকে গোপন আলোচনার অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করা হয়। রাশিয়ার পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব পান কর্নেল জেনারেল সের্গেই বেসেদা। 

প্রথমবার রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের সময় সুলিভান লক্ষ্য করেন, তার রুশ সহকর্মী ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। হঠাৎ বেসেদা টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ান এবং রসিকতার ছলে বলেন, তিনি বৈঠকের বাকি অংশে থাকতে চান না, কারণ তার আর ব্রিফিংয়ের দরকার নেই।

তিনি বলেন, “আমি এফএসবি। আমি সবকিছু নিজেই জেনে নিতে পারি।”

আঙ্কারা বিমানবন্দরের বিশেষ অংশ। জায়গাটি সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ। এখানেই হয়েছিল বন্দি বিনিময়।

কয়েক দিনের মধ্যেই হোয়াইট হাউসে একটি বার্তা পৌঁছায়। সেখানে রাশিয়া জানায়, বন্দি বিনিময় নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা থাকলে সেই আলোচনা শুধু গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে হবে—যেমনটা ছিল শীতল যুদ্ধের সময়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন এই প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রথম বৈঠকটি সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও ফলপ্রসূ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তাদের দেশে দণ্ডপ্রাপ্ত রুশ নাগরিকদের মুক্তি দিতে আগ্রহী ছিল না। কারণ তাদের যুক্তরাষ্ট্রে বিচার ও দণ্ড কার্যকর হয়েছে।

পরে আবারও দুই পক্ষের বৈঠক হয়। এইবার আলোচনার নেতৃত্ব নেয় সিআইএ। আলোচনার লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক মেরিন ট্রেভর রিডকে মুক্ত করার বিনিময়ে রুশ মাদক পাচারকারী কনস্তান্তিন ইয়ারোশেঙ্ককে রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া। রিডকে ৯ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি ও যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে আসছিলেন যে এই অভিযোগ সাজানো।

এই বন্দি বিনিময়ের জন্য তারিখ নির্ধারিত হয় ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল। স্থান ছিল তুরস্কের আঙ্কারার বিমানবন্দর। সিআইএ ও বেসেদার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে একাধিক নথি আদান-প্রদানের মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হয়।

তবে ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মনে সন্দেহ তৈরি হয়—বেসেদা কি এখনও আলোচনার দায়িত্বে রয়েছেন? 

রুশ গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেই সোলদাতভের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়া সরকার পতন করাতে ব্যর্থ হওয়ায় পুতিনের সঙ্গে বেসেদার সম্পর্ক খারাপ হয়। এরপর তাকে লেফোর্তোভো কারাগারে পাঠানো হয়। এই কারাগারটিই হলো সেই বিখ্যাত জেল, যেখানে রাজনৈতিক বন্দিদের রাখা হয়। সেখানে সাংবাদিক ইভান গারশকোভিচসহ যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন নাগরিককেও বন্দি রাখা হয়।

এই খবরে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা দুশ্চিন্তায় পড়েন। তাদের শঙ্কা ছিল, বন্দি বিনিময়ের এই সংলাপ হয়তো ভেস্তে যাবে। তবে কয়েক দিন পর যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা মস্কোতে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নিতে প্রবেশ করেন, তখনই চমক সৃষ্টি হয়—বৈঠকের টেবিলের পেছনে হাসিমুখে বসে ছিলেন বেসেদা।

তিনি মার্ক টোয়েনের বিখ্যাত উক্তি পরিবর্তন করে রসিকতা করে বলেন, “আমার মৃত্যুর খবর কিছুটা বাড়িয়ে বলা হয়েছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads