পৃথিবী কার? চীনের না কি ইউরোপের

EU Chaina

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবী যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক ব্যবস্থায় চলছিল। এর মধ্যে অনেক যুদ্ধ বিগ্রহ ও ঘটনা ঘটলেও, গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিষয়টি প্রায় অটুটই ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় দ্বিতীয় মেয়াদে রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প আসার পর সেই ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। তার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র আর গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিভূ থাকতে চাইছে না। ফলে বিশ্ব নেতৃত্বে সৃষ্টি হয়েছে শূণ্যতা। আর এই শূণ্যতা থেকে বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে কে এনিয়ে আন্তর্জাতিক অলাভজনক মিডিয়া প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে একটি নিবন্ধ লিখেছেন অরভিল শেল। তিনি এশিয়া সোসাইটির যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক বিষয়ক কেন্দ্রের পরিচালক।

“আজ আমরা এক যুগে আছি, আর আগামীকালই থাকবো অন্য এক যুগে।” হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে জোর গলায় কথাগুলো বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ১৯০৯ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার মতে, “এমন কিছু এর আগে কেউ কখনও করেনি!”

এই কথা পুরোপুরি সত্য নয়।

১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর চীনের নেতা মাও সেতুং বেইজিংয়ের নিষিদ্ধ শহরের প্রবেশদ্বার তিয়ানআনমেনের ওপর দাঁড়িয়ে চীনের “লিবারেশন ডে” ঘোষণা করেছিলেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তখন থেকে বিংশ শতাব্দীকে দুই ভাগে ভাগ করেছিল—“মুক্তির আগের সময়” যা ছিল চিয়াং কাই শেকের শাসনে, এবং “মুক্তির পরের সময়” যার শুরু তার অধীনে। এই সময় চীন প্রায় তিন দশক ধরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যায়।

এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষিত “লিবারেশন ডে”ও এমনই এক বিশাল পরিবর্তনের বার্তা দিচ্ছে। তবে এটি শুধু একটি দেশের জন্য নয়, বরং বৈশ্বিক পর্যায়ে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।

বিশেষ করে ইউরোপের জন্য এটি যেন হঠাৎ সূর্য নিভে যাওয়ার মতো। বিশ্ব রাজনীতির যে ভারসাম্য ও পূর্বানুমেয়তা ছিল, তা ভেঙে পড়েছে। গ্রহগুলো যেন তাদের কক্ষপথ থেকে ছিটকে যাচ্ছে। ইউরোপ আগে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। যদিও মাঝে মাঝে তারা যুক্তরাষ্ট্রের আচরণকে অপটু ও সরল ভাবতো। কিন্তু এখন তারা যেন মাধ্যাকর্ষণহীন কোনো গ্রহ। তাদের একা চলতে হচ্ছে। তাদের সামনে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এমন একজন নেতা, যিনি অশোভন আচরণ ও অজ্ঞতার চূড়ান্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

পুরনো ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা এখন বাতিল হয়ে গেছে। এই শূন্যতার মধ্যে চীন ও রাশিয়া এগিয়ে এসে নিজেদের মতো করে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করতে চায়। তবে রাশিয়া একটি শিকড়হীন মার্কসবাদ-লেনিনবাদী শাসনব্যবস্থা। এর হাতে রয়েছে প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম, বিস্তৃত ভৌগোলিক অঞ্চল ও প্রাকৃতিক সম্পদ। কিন্তু এর অর্থনীতি কানাডার চেয়েও ছোট।

অন্যদিকে চীন একটি নবজাগরিত লেনিনবাদী একদলীয় রাষ্ট্র। এর রয়েছে বিশাল অর্থনীতি, এক অসহনশীল নেতা, এবং একটি প্রাণবন্ত আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি খাত। প্রশ্ন হলো, ইউরোপ কি সত্যিই এমন একটি বিশ্ব চায়, যেখানে স্বৈরতন্ত্রই নিরাপদ?

সান ইয়াত-সেন একসময় চীনকে “বিচ্ছিন্ন বালির স্তূপ” বলেছিলেন। ইউরোপ যেন এখন এমন না হয়। ইউরোপকে এখন শুধু নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য সামরিক শিল্পকে জোরদার করাই নয়, বরং একটি অংশত গণতান্ত্রিক বৈশ্বিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও নিতে হবে।

ইউরোপের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে, যা তারা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে। যেমন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার ইউরোপের প্রতিরক্ষা-ছাতা হিসেবে কাজ করতে পারে। জার্মানির ‘রাইনমেটাল’ জাতীয় অস্ত্র প্রস্তুতকারীরা, ইউক্রেনের ড্রোন প্রযুক্তিতে দক্ষতা, যুক্তরাজ্যের ‘বিএইই’, ফ্রান্সের ‘এয়ারবাস’, এবং নেদারল্যান্ডসের ‘এএসএমএল’—যাদের কাছে উন্নত মাইক্রোচিপ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইইউভি প্রযুক্তির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে—সবই ইউরোপের শক্তি।

তবু ইউরোপ এখনো এমন কোনো জোট কাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়নি, যা যুক্তরাষ্ট্র এখন ত্যাগ করেছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে ইউরোপ দেখাতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব না দিলেও এই বিশ্ব চীনের একার নয়।

ট্রাম্পের ন্যাটোবিরোধী মনোভাবকে বিবেচনায় রেখে, গণতন্ত্র ও বৈশ্বিক শৃঙ্খলার পক্ষে থাকা ইউরোপীয় ও এশীয় দেশগুলোর উচিত এখনই সতর্ক হওয়া। তাদের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা ও চীনের অর্থনৈতিক প্রভাবের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের মধ্যে ও সমমনা দেশগুলোর সঙ্গে নতুন ধরণের অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা। সর্বদা স্পর্শকাতর ভারতও এ বিষয়ে একমত এবং দেশটি এক সম্ভাব্য সহযোগী হিসেবে এগিয়ে আসতে পারে।

এমন একটি নতুন কাঠামোই এক সময় ফ্রান্সের জন্য চেয়েছিলেন শার্ল দ্য গোল। ১৯৫০-এর দশকে ফ্রান্স যখন ন্যাটোতে যোগ দেয়, তখন দ্য গোল আশঙ্কা করেছিলেন—সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরোপ আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। তিনি স্পষ্টভাবে আমেরিকানদের বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে তারা প্যারিস রক্ষার জন্য নিউইয়র্ক উৎসর্গ করবে।

এই কারণে দ্য গোল ফ্রান্সের নিজস্ব পারমাণবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ফোর্স ডি ফ্রাপ্পে গড়ে তোলেন। এরপর ১৯৬৬ সালে তিনি ন্যাটোর সামরিক কমান্ড থেকে ফ্রান্সকে প্রত্যাহার করে নেন। যদিও ফ্রান্স জোটের সদস্য হিসেবেই থেকে যায়। সে সময় অনেকে দ্য গোলের এই সিদ্ধান্তকে জেদ বা অহঙ্কারের প্রকাশ বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তার সেই ভাবনা ছিল অনেক দূরদর্শী।

নানাবিধ আলোচনা, কূটনৈতিক সংলাপ, বাণিজ্য চুক্তি, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং জন-কূটনীতি—যেগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতির পরিচিত উপাদান—এসব কোনো কিছুই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কিংবা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বদলাতে পারবে না।

কারণ তারা বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার অংশীদার হতে চায় না। বরং তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা সেই নেতৃত্বে যেতে চায়। শুধু তাই নয়, তারা বিশ্ব ব্যবস্থাটিকেও নিজেদের মতো করে বদলে দিতে চায়।

চীনের নেতা মাও সেতুং একবার বলেছিলেন, “ধ্বংস ছাড়া নির্মাণ সম্ভব নয়”। এই কথার মধ্যে কিছু সত্য রয়েছে। ট্রাম্পও একধরনের ধ্বংসের দূত। কিন্তু ইউরোপ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে সঠিকভাবে কাজ করলে ট্রাম্প হয়তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও নির্মাণের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারেন। তিনিই হতে পারেন এমন একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার ‘ধাত্রী’, যা যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গঠিত নয়।

তবে ইউরোপীয়দের মনে রাখা উচিত, যুক্তরাষ্ট্র আগেও এমন এক ধরণের ‘সহযোগিতামূলক’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। শুধু সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়ার সঙ্গে নয়, চীনের সঙ্গেও। ১৯৭২ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত দশজন প্রেসিডেন্ট—প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনসহ—চীনের সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন রকমের ‘সম্পৃক্ততা’ নীতিকে সমর্থন করেছিলেন।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এই সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) নেতারা এখনো বিশ্বাস করেন—যুক্তরাষ্ট্র মূলত চীনের একদলীয় শাসনব্যবস্থা উৎখাত করতে চায়, সে আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা যাই বলুন না কেন।

তারা প্রায়ই স্মরণ করেন, ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডুয়াইট আইজেনআওয়ারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেস বলেছিলেন, সোভিয়েত শাসন থেকে “মুক্তি” যুদ্ধ ছাড়াই অর্জন করা যেতে পারে। তার মতে, অভ্যন্তরীণ শান্তিপূর্ণ চাপের মাধ্যমেই কমিউনিস্ট শাসনের চরিত্র পরিবর্তন সম্ভব। ১৯৫৮ সালে ডালেস আবারো যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের পরামর্শ দেন, চীন-সোভিয়েত ব্লকের মধ্যে এমন পরিবর্তনের গতি বাড়ানো উচিত, অবশ্যই শান্তিপূর্ণ উপায়ে।

এই “শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন” ধারণা মাও সেতুংকে ভীত করেছিল। তিনি এটিকে সরাসরি যুদ্ধের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক কৌশল হিসেবে দেখেছিলেন। কারণ এটি যুদ্ধ না করে ধীরে ধীরে সমাজকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে এবং শেষে পুরো কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

বর্তমান চীনা নেতা শি জিনপিংও যুক্তরাষ্ট্রকে বরাবরই একটি “শত্রুভাবাপন্ন বিদেশি শক্তি” হিসেবে দেখেন। তার দৃষ্টিতে, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই বন্ধুত্বপূর্ণ নয়।

আর এই কারণে, ইউরোপের উচিত নয় চীনকে নিয়ে কোনো ভুল ধারণা পোষণ করা। আজকের বিশ্বে স্বৈরশাসকরা আরও সাহসী হয়ে উঠছে। তাই শান্তি নিশ্চিত করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো—শক্তিশালী সামরিক প্রতিরক্ষা, মজবুত জোট ও অর্থনৈতিক প্রভাব। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু এখন আর গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্বে আগ্রহী নয়, তাই ইউরোপেরই দায়িত্ব এই ভূমিকা গ্রহণ করা। এই কাজ অন্য কেউ করবে না।

আরও পড়ুন