ইসরায়েলি কারাগারে কেন এত ফিলিস্তিনি শিশু?

২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট পশ্চিম তীরের নাবলুস শহরের কাছে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ১৫ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি যুবক হাসান খালিফেহকে পাহারা দিচ্ছেন একজন ইসরায়েলি সৈন্য। ছবি: রয়টার্স
২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট পশ্চিম তীরের নাবলুস শহরের কাছে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ১৫ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি যুবক হাসান খালিফেহকে পাহারা দিচ্ছেন একজন ইসরায়েলি সৈন্য। ছবি: রয়টার্স

গাজায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওয়তায় ইসরায়েলে বন্দি ২৩ ফিলিস্তিনি শিশুকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে; যার মাধ্যমে ইসরায়েলের সামরিক আদালতে শিশুদের বিচারের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।

গত ১৯ জানুয়ারি কার্যকর হওয়া ওই যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর দুই দফায় অন্তত ২৯০ জন ফিলিস্তিনি কারাবন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল।

ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীর ভিত্তিক আদামির প্রিজনার সাপোর্ট এবং হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুসারে, সাম্প্রতিক এই বন্দি বিনিময়ের আগে ইসরায়েলের কারাগারে ৩২০ ফিলিস্তিনি শিশু বন্দি ছিল।

শিশু বন্দি সম্পর্কে কী জানা গেল?

২০১৬ সালে ইসরায়েল নতুন একটি আইন পাস করে। যার আওতায় ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের অপরাধী সাব্যস্ত করে প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো বিচার ও দণ্ড দেওয়া যাবে। আগে যা ১৪ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। তবে নতুন আইন অনুযায়ী দণ্ড দেওয়া গেলেও তা ১৪ বছর পূর্ণ হওয়ার পর থেকে কার্যকর হবে।

ইসরায়েলের আইনসভা ক্নেসেট ২০১৬ সালের ২ অগাস্ট আইনটি প্রণয়ন করে। আইন প্রণয়নের সময় আইনসভার বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘হত্যা, হত্যা চেষ্টা এবং হত্যায় জড়িতরে মতো গুরুতর অপরাধে জড়িত শিশুদের বন্দি করার’ অনুমতি দেয়া হলো। এমনকি তার বয়স ১৪ বছরের নিচে হলেও।

অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেম থেকে ২০১৫ সালে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে আহমেদ মানাসরা নামে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরকে গ্রেপ্তারের পর নতুন এ আইনটি পাস করা হয়। নতুন আইন পাসের পর তাকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং তা তার চৌদ্দতম জন্মদিনের দিন বাস্তবায়িত করা হয়। পরে আপিল করা হলে তার দণ্ড কমিয়ে নয় বছর করা হয়।

বেসরকারি সংস্থা সেইভ দ্য চিলড্রেনের হিসাব অনুযায়ী গত ২০ বছরের ১০ হাজার শিশুকে ইসরায়েলি সামরিক কারাগারে রাখা হয়।

শিশুদের গ্রেপ্তারের কারণের মধ্যে পাথর নিক্ষেপসহ অনুমতি ছাড়াও ১০ জন একসঙ্গে জমায়েত হলেও তা প্রযোজ্য।

কোন আইনে শিশুদের আটক?

ইসরায়েল বিতর্কিতভাবে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বেসামরিক আদালতে বিচার না করে সামরিক আদালতে বিচার করে থাকে। যদিও আন্তর্জাতিক আইন ইসরায়েলকে তার অধিকৃত অঞ্চলে সামরিক আদালত পরিচালনার অনুমতি দেয়।

দখলকৃত পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুজালেমে দুই ধরনের বিচার ব্যবস্থা চালিয়ে থাকে ইসরায়েল। সেখানে বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলিদের সাধারণ এবং ফিলিস্তিনিদের সামরিক আদালতে বিচার করা হয়ে থাকে। যার ফলে অনেক ফিলিস্তিনি যথাযথ বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই কারাবন্দি হয়।

২০২৩ সালের নভেমআবরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন পরিচালক ওমর শাকির লিখেছিলেন, “রাতে অভিযান চালিয়ে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনি শিশুদের গ্রেপ্তার করে, অভিভাবকের উপস্থিতি ছাড়াই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং ১২ বছর বা তার কম বয়সীদের বিচারকের সামনে উপস্থান করা ছাড়াই দীর্ঘ সময় আটকে রাখে।”

ইসরায়েলি সিভিল রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দখলকৃত পশ্চিম তীরের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ফিলিস্তিনি শিশু বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত আটক থাকে; আর ইসরায়েলি শিশুদের হার ২০ শতাংশেরও কম।

ইসরায়েলে বন্দি শিশুদের ২০২০ সালে থেকে প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর একবার ১০ মিনিট করে পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দেয়।

মুক্তিপ্রাপ্তদের কত জন শিশু?

অস্ত্রবিরতি চুক্তির আওতায় শনিবার ইসরায়েল দুইশ’ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিয়েছে, যার মধ্যে ১২০ জন যাবজ্জীবন সাজা প্রাপ্ত ছিল। এছাড়া দুই শিশু রয়েছে যাদের বয়স ১৫ বছর। আর সবচেয়ে বয়স্ক মুহাম্মদ আল-তৌস ৬৯ বছর বয়সী। ১৯৮৫ সালে ইসরায়েলের সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে গ্রেপ্তারের পর ৩৯ বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি।

দীর্ঘ ১৫ মাসের রক্তাক্ত আগ্রাসনের পর যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুসারে শনিবার দ্বিতীয় দফা হিসেবে এদের মুক্তি দেওয়া হয়। প্রথম দফায় তিন ইসরায়েলি বন্দির বিনিময়ে ৯০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয় ইসরায়েল। যার মধ্যে ৬৯ জন নারী ও ২১ শিশু ছিল।

এদের মধ্যে মাত্র আটজন ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের হামলার আগে আটক হয়েছিল। এ হামলায় ১১শ’ নিহত হয় এবং ২৫০ জনকে ধরে নিয়ে আসে তারা। এরপরই গাজায় সর্বাত্মক হামলা চালায় ইসরায়েল।

ফিলিস্তিনি এসব বন্দির মধ্যে অনেকে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি কারাগারে রয়েছেন।

ফিলিস্তিন ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট (ফাতাহ) এর সহপ্রতিষ্ঠাতা মারওয়ান বারঘৌতি ২২ বছর ধরে ইসরালেলি কারাগারে বন্দি রয়েছেন। দখলের আগে পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণে ছিল ফাতাহর।

দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক তামার ক্বারমাউত  আল জাজিরাকে বলেন, ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি পরিবারগুলির জন্য ‘অনেক বড় উপশম’ হলেও তা ঘটছে “ইসরায়েলি দখলের ভয়াবহ বাস্তবতার মধ্যে”।

তিনি বলেন, আলোচনার মাধ্যমে সংঘর্ষ শেষ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দখল শেষ করার মতো বড় একটি চুক্তিতে এসব বন্দিদের মুক্তি পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কঠোর বাস্তবতা হলো দখল অব্যাহত আছে।

কত ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি কারাগারে?

আদামিররে রোববারের তথ্য অনুসারে ইসরায়েলের কারাগারে ১০ হাজার চারশ’ ফিলিস্তিনি রয়েছে, যারা গাজা ও পশ্চিম তীরের। ফিলিস্তিনের দখলকৃত অঞ্চলের প্রতি পাঁচজনে একজন কোনো না কোনো সময় গ্রেপ্তার হয়ে বিচারের সম্মুখীন হয়েছে। তবে শুধু পুরুষদের মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিগুণ; প্রতি পাঁচজনে দুইজন।

ইসরায়েলের ১৯টি কারাগার রয়েছে। এর মধ্যে একটি দখলকৃত পশ্চিমতীরে যেখানে ফিলিস্তিনি বন্দিদের রাখা হয়। গত অক্টোবর থেকে ইসরায়েল সেখানে স্বতন্ত্র মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। ফলে ভেতরে কত বন্দি এবং তারা কী অবস্থায় রয়েছে তা জানা কঠিন হয়ে যায়।

গাজায় আগ্রাসন শুরু হওয়ার আগে ও পরে বন্দি হওয়া ফিলিস্তিনিরা জানিয়েছেন, কারাগারে তারা মারধর, নির্যাতন এবং অবমাননার শিকার হয়েছেন।

বিনা অভিযোগে আটক কত?

আদামির তথ্যানুসারে ইসরায়েল প্রশাসনিক আটকাদেশের অধীনে ৩ হাজার ৩৭৬ জন ফিলিস্তিনি বন্দি আছে। প্রশাসনিক আটকাদেশ হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে কাউকে বিনা বিচার বা বিনা অভিযোগে কারাবন্দি করে রাখা যায়।

প্রশাসনিক আটকাদেশে আটকদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ‘গোপন প্রমাণ’ থাকার দাবি করে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ, যা তাদের আইনজীবীদেরও দেখার অনুমতি নেই। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই তারা এমনটি করে আসছে।

 ৪১ শিশু ও ১২ নারী প্রশাসনিক আটককৃতদের মধ্যে রয়েছে বলে আদামির জানিয়েছে।

এরপর কী?

যুদ্ধবিরতির প্রথম দফার ছয় সপ্তাহের মধ্যে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ২৬ জন অন্যান্য বন্দিকে মুক্তি দেয়া হবে। পরবর্তী বন্দি বিনিময় আগামা শনিবার হওয়ার কথা রয়েছে।

অনেকের প্রত্যাশা পরবর্তী ধাপ ২৩ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত এবং হাজার হাজার মানুষের প্রাণ নেওয়া গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। এ পর্যাযের আলোচনা আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

আল জাজিরা অবলম্বনে

আরও পড়ুন