যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একে অপরের আমদানির উপর ৯০ দিনের জন্য শুল্ক আরোপ স্থগিত করতে সোমবার একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে ‘শুল্কযুদ্ধ’ শুরু করেছিলেন, তাতে কিছুটা স্বস্তি এনেছে। ট্রাম্প প্রাথমিকভাবে বেশিরভাগ দেশের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপ ঘোষণা করলেও, পরে তিনি বেশিরভাগ দেশের বিরুদ্ধেই শুল্ক আরোপ স্থগিত করেন- বাদ রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একে অপরের বিরুদ্ধে যে ধরনের শুল্ক আরোপ করেছিল, তা শিল্পের জন্য বোঁঝায় পরিণত হয়েছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য আগ্রহী চীনা পণ্যের উপর ১৪৫ শতাংশ এবং চীনা বাজারে প্রবেশের জন্য আগ্রহী মার্কিন পণ্যের উপর ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত ছিল।
সোমবার, ট্রাম্প বলেছিলেন যে তিনি সপ্তাহের শেষ নাগাদ তার প্রতিপক্ষ শি জিনপিংয়ের সাথে কথা বলতে পারেন। তিনি আরও বলেন যে অর্থনৈতিক আলোচনা দুই দেশের মধ্যে “পুনঃস্থাপিত” হয়েছে।
চীন ও আমেরিকা কী বলল?
সোমবার যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে শুল্ক স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় দুই দিনের বাণিজ্য আলোচনার পর এই স্থগিতাদেশ জারি করা হয়।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে, ট্রাম্প বারবার বলেছিলেন যে চীনের সাথে শুল্ক আলোচনা চলছে, কিন্তু বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা জেনেভায় বৈঠকের আগে তা অস্বীকার করে আসছিলেন।
সোমবারের বিবৃতিতে, দুই দেশ বলেছে যে তারা তাদের “দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্কের” গুরুত্বের পাশাপাশি “টেকসই, দীর্ঘমেয়াদী এবং পারস্পরিকভাবে উপকারী অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক”-এর গুরুত্ব স্বীকার করে।
বিবৃতিতে বলা হয়, উভয় দেশ বুধবারের মধ্যে বেশিরভাগ শুল্ক স্থগিত করার পদক্ষেপ নেবে।
শুল্ক হ্রাসের শর্তাবলী কী কী?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের উপর শুল্ক ১৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে, যেখানে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর শুল্ক ১২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
২ এপ্রিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের উপর ৩৪ শতাংশ “পারস্পরিক শুল্ক” আরোপ করে। এর আগেই দেশটির পণ্যের উপর শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ। পূর্ববর্তী শুল্ক আরোপের পেছনে ট্রাম্পের যুক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানাইলের আসক্তির জন্য চীন দায়ী, যার কারণে হাজার হাজার আমেরিকানের জীবন ধ্বংস হচ্ছে।
কার্যত ২ এপ্রিল চীনা পণ্যের উপর ৫৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপের দাঁতভাঙা জবাব দেয় বেইজিং, তারাও মার্কিন পণ্যে বসিয়ে দেয় ৩৪ শতাংশ শুল্ক।এরপর দুই দেশের উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে, সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে শুল্কের মাত্রা। শেষ পর্যন্ত চীনের পণ্যের উপর মার্কিন শুল্কের অঙ্ক দাঁড়ায় ১৪৫ শতাংশে, আর মার্কিন পণ্যে চীনের শুল্ক ১২৫ শতাংশে।
এ তো গেল শুল্কযুদ্ধের মহারণ। ১২ মে অবশ্য দুই দেশই ২ এপ্রিল এবং পরবর্তীকালে আরোপিত সমস্ত শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সম্মত হয়। তবে যদি ২ এপ্রিলের পূর্ববর্তী শুল্ক হিসাব করা হয়, তাহলেও চীনা পণ্যের উপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হবে।
৯০ দিনের স্থগিতাদেশের লক্ষ্য কী?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের যৌথ বিবৃতি অনুসারে, তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়েছে।
“এই পদক্ষেপটি মূলত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি মার্কিন-চীন সম্পর্কের বৃহত্তর গতিপথে প্রকৃত পরিবর্তনের পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পশ্চাদপসরণকে প্রতিফলিত করে,” আফ্রিকা প্রোগ্রামের চ্যাথাম হাউসের সহযোগী ফেলো কার্লোস লোপেস আল জাজিরাকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেন।
লোপেস ব্যাখ্যা করে বলেন, শুল্ক প্রত্যাহারের ফলে চীন তার অবস্থান ধরে রেখেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার পদ্ধতি সংশোধন করতে বাধ্য করেছে।
“এই অর্থে, এই প্রত্যাহার গভীরভাবে আন্তঃসংযুক্ত বিশ্ব অর্থনীতিতে দাপট এবং একতরফা আধিপত্যের সীমা নির্দেশ করে। এটি একটি কৌশলগত বিরতি, কৌশলগত পুনর্বিন্যাস নয়।”

ট্রাম্প কেন এ পথে গেলেন?
“এই প্রত্যাহার হল দেশীয় অর্থনৈতিক চাপের স্বীকৃতি,” যোগ করেন লোপেস। তিনি আরও বলেন যে শুল্ক আমেরিকান ভোক্তাদের জন্য দাম বাড়িয়ে দিচ্ছিল এবং মূল উৎপাদন খাতগুলিকে, বিশেষ করে যারা চীনা মধ্যবর্তী পণ্যের উপর নির্ভরশীল, তাদের ক্ষতি করছিল।
“মার্কিন অর্থনীতি, তার বিশালতা সত্ত্বেও, গুরুতর ক্ষতি ছাড়া বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। তাছাড়া, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আলোচনার মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শনে সাফল্য অর্জন করেন – কিন্তু কাঠামো বা স্পষ্ট পরিণতি ছাড়াই দর কষাকষি অবশেষে তার দুর্বলতা প্রকাশ করে। এই পুনর্নির্মাণ এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে প্রতিফলিত করে,” তিনি বলেন।
লোপেস বলেন, বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পেছনে ফেন্টানাইল এবং মারাত্মক সিন্থেটিক ওপিওয়েডের সরবরাহ শৃঙ্খলে চীনের ভূমিকা- কখনই প্রধান কারণ ছিল না।
“ফেন্টানাইল জনসাধারণের আলোচনার অংশ ছিল। কিন্তু শুল্ক সিদ্ধান্তের মৌলিক চালিকাশক্তি ছিল না। এটি রাজনৈতিক বার্তা প্রেরণের জন্য, বিশেষ করে দেশীয় দর্শকদের কাছে একটি প্রতীকী বিষয় হিসেবে কাজ করেছে। এখানে মূল গতিশীলতা হল কাঠামোগত- সরবরাহ শৃঙ্খলের আন্তঃনির্ভরতা, মুদ্রাস্ফীতিজনিত উদ্বেগ এবং নির্বাচনী হিসাব – ওষুধ নীতি নয়,” চ্যাথাম হাউস বিশ্লেষক বলেন।
বিবৃতিতে, উভয় দেশ আলোচনার জন্য প্রতিনিধিদের নাম দিয়েছে।
চীনের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য স্টেট কাউন্সিলের ভাইস প্রিমিয়ার হি লাইফেংকে মনোনীত করা হয়েছে। মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট এবং বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মনোনীত করা হয়েছে।
বিশ্ববাজারে প্রতিক্রিয়া কেমন?
সোমবারের ঘোষণার ফলে স্টক এবং ডলারের দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার এসঅ্যান্ডপি ৫০০ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৮৪.২৮ পয়েন্ট, ডাউ জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ ১১৬১ এবং নাসডাক কম্পোজিট ৭৭৯.৪৩ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইউরোর মূল্য হারায় দেড় শতাংশ, ১.১০৭৮ এ দাঁড়িয়েছে। ইয়েন দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং মার্কিন মুদ্রা ২.১ শতাংশ বেড়ে ১৪৮.৪৯ এ দাঁড়িয়েছে।
এর আগে ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব বাজারে উল্লেখযোগ্য পতন দেখা গিয়েছিল।
মার্কিন-চীন বাণিজ্য: গভীর চ্যালেঞ্জ
বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন, উভয়ই দীর্ঘকাল ধরে অর্থনৈতিক প্রাধাণ্যের জন্য প্রতিযোগিতা করে আসছে, যদিও প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে একে অপরের উপর নির্ভরশীল।
অবজারভেটরি অফ ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটি অনুসারে, ২০২৩ সালে চীনের রপ্তানির ১২.৯ শতাংশের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
কানাডা এবং মেক্সিকোর পরে চীন হলো যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। ২০২৩ সালে চীনা পণ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানির ১৪.৮ শতাংশ।
এই বাণিজ্য মার্কিন ভোক্তাদের সাশ্রয়ী মূল্যের পণ্য যেমন সরবরাহ করে, তেমনি মার্কিন কোম্পানিগুলোও চীনে রপ্তানির মাধ্যমে বার্ষিক বিলিয়ন ডলার আয়ের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
মার্কিন আর্থিক পরিষেবা সংস্থা গোল্ডম্যান শ্যাক্সের বিশ্লেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে তার বাণিজ্য যুদ্ধ অব্যাহত রাখে, তাহলে চীনে ১ কোটি ৬০ লাখ চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে চীনের সঙ্গে একটি “বাণিজ্য যুদ্ধ” শুরু করেছিলেন, দেশটির সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে। ২০২৪ সালে, চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২৯৫.৪ বিলিয়ন ডলার – যা যেকোনো বাণিজ্য অংশীদারের তুলনায় সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি।
যদিও চীনা নেতৃত্ব ধারাবাহিকভাবে যুক্তি দিয়ে আসছেন যে বাণিজ্য যুদ্ধ কারও উপকারে আসে না, প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ট্রাম্পের বেশ কয়েকটি শুল্ক অব্যাহত রেখেছেন এবং সেগুলোর সঙ্গে আরও বেশ কিছু যুক্ত করেছেন।
আল-জাজিরা অবলম্বনে