কর্মজীবনের বিরতি নাকি শেষ কী বলব বুঝতে পারছি না। তবে ২০১৮ সালের অগাস্টে শেষবারের মতো কিবোর্ডে আঙ্গুল রেখেছিলাম। তারপর দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ছয় বছর সে জীবনের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন। নতুন করে আবার শুরুর চিন্তা ভাবনা করলে নিজের সামনে নিজেই কিছু বিঘ্ন চিন্তা করে পিছিয়ে এসেছি। তবে এবার এমন একজন থেকে আদেশ কলম ধরার যে না করতে পারিনি। আবার লেখার চেষ্টাই বলবো এটাকে আমি। জানি না তার ভরসা কতটুকু রাখতে পারব। লেখা শুরুর আগে একটা অনুরোধ জানাব এই ভাবনায় কেউ অনুপ্রাণিত হবেন না।
আমাদের দেশে শিশুর জন্মের পরর লালন পালনের দায় শুধু মায়ের ওপরেই বর্তায়। পরিবার-সমাজ সবার মনোভাব এমন যেন ‘বাচ্চা জন্ম দিয়েছো তুমি তাই দায়ও তোমার’।
কিন্তু এই শিশুকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার বাসনার ভার মায়েরা কতোটা পায়? আদৌ সে কারো পরিপূ্র্ণ দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত কিনা- সে বিষয়টা ভেবে দেখার প্রয়োজনও কেউ অনুভব করে না। বাচ্চা নাও বাচ্চা নাও করে যেমন তার জীবনটা অতিষ্ট করে দেয়। ঠিক তেমনি ভাবে না শিশুর জন্মের পর মায়েদের ক্যারিয়ার নিয়ে। সমাজ সংসারের ভাবটা এমন বাচ্চা লালন পালনের যাবতীয় দায়িত্ব নারীর একার। সন্তান জন্মের পর নতুন মায়ের সামনে এতো এতো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যে ‘বেচারির’ নাস্তানাবুদ অবস্থা। আর যখন বাচ্চা দেখভালের ব্যাপার সামনে আসে তখন প্রথম কোরবানি হয় মা যদি চাকরিজীবী হয় তবে তার চাকরি।
আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক এমনটা না হলেও চাকরি ছাড়ার কারণ আমার সন্তান। আর বিষয়টা ঘটেছে আমার নিজ সিদ্ধান্তে।
বেড়ে ওঠা এমন একটা জায়গায় যেখানে পড়াশোনা করতে হলেও কষ্ট করতে হয়। তিন-সাড়ে তিন মাইল হেঁটে স্কুলে যেতে হতো, বর্ষায় জুতা স্যান্ডেল বগলে নিয়ে, গ্রীষ্মে প্রচণ্ড খরতাপে পুড়ে। এতোটা পথ হেঁটে বিদ্যার্জন তখনই সম্ভব হয় যখন ভেতরে কিছু একটা হওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকে। সেই ইচ্ছা বা স্বপ্নের জোরেই ওই রাস্তা পেরিয়ে স্কুল পাস সম্ভব। আর নাহলে ঝরে পড়া।
খুব ভালোভাবে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। পড়াশোনা করতে করতে চতুর্থ বর্ষেই কর্মজীবনের প্রবেশ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম আমার প্রথম ও একমাত্র কর্মস্থল। ২০০৮ এর জানুয়ারি থেকে টানা ১১ বছর সেখানেই।
বিয়ে করার পর যখন চাকরি বিষয়ে প্রথম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হই তখন মনে হতো যেকোনো মূল্যে চাকরিটা করে যেতে হবে। করেছিও তাই।
তারপর আমার জমজ সন্তান এলো কোল জুড়ে। তার মধ্যে মেয়েটা সারারাত কাঁদে। মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং বিনা বেতনে আরও একমাস বাড়তি ছুটির পর যখন কাজে ফিরে গেলাম তখনও মেয়ের ঘুমের চক্র ঠিক হয়নি। রাত নামলে মনে হয় ওর মাত্র সকাল হলো। সারারাত মেয়েকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি, ভোরে উঠে রান্না-বান্না করে ওদের সব কিছু গুছিয়ে কাজের সহকারী মেয়েটিকেসহ বোনের বাসায় নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাওয়া।
ফেরার পথে ওদের সাথে করে বাসায় নিয়ে এসে রাতের খাবার প্রস্তুত করা। কাজে ফেরার পর প্রথম যে বিষয়ে কষ্ট পেলাম সেটা কাউকে বোঝানো যাবে না। সেটা হলো আমার ছেলেটা অভিমান করে বুকের দুধ খাওয়া ছেড়ে দিল। সারাদিন পায় না তাই সন্ধ্যায় বাসায় এসে দিলে আর সে খায় না। মুখ ঘুরিয়ে রাখে। একজন মায়ের জন্য এটা অনেক বড় একটা বিষয়। অন্যরা এই অনুভূতি বুঝবে কী না জানি না।
এদিকে অফিসে যে খুব সহযোগিতা পাচ্ছি তাও নয়। ছোট ছোট দুটো বাচ্চা, তাদের অসুস্থতায়; রাখার লোকের অভাবে হরহামেশাই ছুটির প্রয়োজন হচ্ছে। খালি ছুটি কাটাই এমন বদনাম। অফিস ছুটি হলেই বাসায় ছোটে। বাড়তি কাজে পাওয়া যায় না। রিপোর্টিং বসকে বাংলাদেশি শাশুড়িদের মতো মনে হতো তখন। পুত্রবধূদের সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিই যাদের কাজ। রিপোর্টিং বসও এডিটরের কাছে নালিশ আর সামনে প্রতিবন্ধকতা তৈরিই করে যেতেন। তিনি নানা অজুহাতে নিজে ‘হোম অফিস’ করলেও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের কমতি ছিল না। মনে আছে একদিন কাজ শেষে শিফট ইন চার্জকে বের হচ্ছি বলতে গেছিলাম। উনি বললেন আসছিলেনই কেন? যা আমি কোনোদিনও ভুলব না। তিনি কিন্তু বাজারে বেশ প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত।
তবে ব্যতিক্রম কেউ ছিল না তা নয়। তাদের মধ্যে একজন রুবাই ভাই। ডেস্কে আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র। আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব তার প্রতি। সদ্য মা হওয়া সহকর্মীকে তিনি যে সহমর্মিতা দেখিয়েছেন তা অনেকেই পারেননি। যাদের দেখানো উচিত ছিল। ওই সময়ে একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে অনেক মায়েরই কাজ চালিয়ে যাওয়া সহজ হয়।
ঘরে বাইরে সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে কাজ চালিয়ে গেছি। কাজ করতে হবে। এরমধ্যে একদিন দেখি বাচ্চারা হাঁটে, আমাকে মা ডাকে। আমি দেখিনি ও কখন প্রথম পা ফেলে হাঁটতে শিখেছে। কবে প্রথম কথা বলেছে। এক সময় তো ছেলে অন্য সবার মতো আমাকে নাম ধরে ডাকত। কারণ মা দৌড়চ্ছে। রাতে বোনকে নিয়ে হাঁটছে, সকালে সবার খাবার বানাচ্ছে, তারপর তাদের রেডি করে খালার বাসায় নামিয়ে অফিসে যাচ্ছে, ফিরে আবার সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।
বন্ধুরে যখন দেখি নিয়ম করে বাচ্চার যত্ন নিচ্ছে, পুষ্টিকর খাবার দিচ্ছে। কোনো বেলায় ফলের পিউরি, কোনো বেলায় সবজির পিউরি, কোন বয়সে কোন ফল, কোন সবজি। আমার তখন মনে হয়, হায় হায় আমি তো এসব করিনি! আমি তো এতো সময় আমার বাচ্চাদের দিইনি।
একদিন অফিসে কাজ করছি হঠাৎ বাচ্চাদের দেখাশোনা করার মেয়েটার ফোন। বলে আপা এখনি বাসায় আসেন। আমি ভেবেছি অন্য কাজের জন্য রাখা মেয়েটার সাথে ওর ঝগড়া হয়েছে হয়তো। দ্রুত অফিস থেকে বেরিয়ে নিচে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তার জন্য আমি মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার মেয়ের তখন চার বছর বয়স। বাসার নিচে আমার মেয়েকে কোলে করে দাঁড়িয়ে আছে আর মেয়ের পায়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে আছে একটা টুথপিক। একজন মায়ের কাছে সেই দৃশ্য কেমন তা শুধু সেই মা-ই জানেন। মেয়ের পায়ে কিভাবে ঢুকেছে, দুই দুইজন দেখাশোনার লোক তখন কী করছিল তা আজও অজানা।
তারপরও কিছু হওয়ার স্বপ্ন, কিছু করার স্বপ্ন থেকে কাজ ছাড়িনি। চালিয়ে গেছি। বাচ্চাদের যখন স্কুলে দিলাম তখন দেখলাম আমার জন্য ওদের কষ্ট হচ্ছে। আমার ঘড়ির সাথে ছোট মানুষ দুটো ছুটে ক্লান্ত। আমার ছুটি-ওদের ছুটি মেলে না। তারপরও সব মানিয়ে গুছিয়ে চলে যাচ্ছিল। মায়ের মর্নিং-ইভনিং-লেটনাইট সব ডিউটির সাথে তারাও মানিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওরা যখন আরেকটু বড় হলো দেখি ওরা আমার কাজের সহকারীর মতো ভাবে। লাল পিঁপড়া হিন্দু, কালো পিঁপড়া মুসলমান। এমনকি ওর মতো করে জোতির্বিজ্ঞানও ব্যাখ্যা করছে। মনে হলো অনেক হয়েছে। এবার ওদের সময় দিতে হবে। ওদের বেড়ে ওঠা দেখা মিস করতে চাই না। ওদের শৈশবটা নিরাপদ করতে হবে। যা যা প্রথম আমার অজান্তে ঘটে গেছে, তা গেছে। শুধু মেয়ে নয় আমার ছেলের ছেলেবেলাও নিরাপদ করব। নিজের ছেলেবেলায় ভালো খারাপ স্পর্শ না চেনায় যা হয়েছে আমার সন্তানদের সাথে এমনটা হতে দেব না। সব শেখাব এবং ছায়া হয়ে পাশে থাকব। মেয়ের প্রথম পিরিয়ড হলে যেন লুকিয়ে কাঁদতে না হয়, আমি যেন সেদিন সেই মুহূর্তও তার পাশে থাকতে পারি। সে যেন সেদিন তার মায়ের অভাব অনুভব না করে। ছেলে-মেয়ের প্রতিটা অর্জনে পাশে থাকব, তার যেন মনে হয় মা আজকেও এলো না। আমি আর ওদের আনন্দ বেদনা মিস করতে চাইনি। সবকিছু স্মৃতিতে রাখতে চেয়েছি।
কতটা শুধু নিজের সেই কঠিন অর্জন কাজে লাগাতে শত প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ চালিয়ে গেছি। এক সময় এমন গেছে আমি রাতে দু ঘণ্টা ঘুমিয়েছি কি না সন্দেহ। সেই আমি একদিন হুট করে সিদ্ধান্ত নিলাম আর কাজ করবো না। ছেড়ে দেব। আমার সাথে দৌড়ে আমার বাচ্চা পেরেশান হয়ে যাচ্ছে। ওদের কষ্ট হচ্ছে। এছাড়া ওদের বেড়ে ওঠা আমি দেখছি না। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দিলাম কাজ ছেড়ে। তারপর থেকে আমি পাকাপাকি গৃহিণী।
আমার এই চাওয়া ভুল শুদ্ধ সে বিচারে যাব না। এই ভাবনা সাহসী নাকি দুর্বলতা সে বিচারেও আমি কখনও যাই না। হঠাৎ করে নিজের একটা জানালা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর খুব সাধারণ আটপৌড়ে হয়ে বাঁচা অনেক কঠিন সেটা অবশ্যই বলতে পারি। নিজেকে সব থেকে গুটিয়ে ঘরবন্দি করে ফেলতে অনেকটা মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়েছে। অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। এতো লেখাপড়া করে এখন ভাত রান্না করা কোনো কাজের নয় সেটাও ইনিয়েবিনিয়ে শুনতে হয়েছে। আমাকে দেখে আরও অনেকে অনুপ্রাণিত হবে এমনটাও শুনেছি।
এতোজনের এতো কথা শুনে বা এতো এতো পড়াশোনা করে এখন কিছু না করা নিয়ে আমার কখনও আফসোসও হয়নি। তবে একটা গ্লানি হয় মাঝে মাঝে। আর সেটা হলো আমারই সমবয়সী একটা ছেলের ওপর নিজের ভার চাপানোর। যা কখনো চাইনি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে সামনে এগুতে চাইছি। কিন্তু দেখলাম মাতৃত্ব এবং সন্তান এই দুইটা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। এখানে আত্মাভিমান, গরিমা, মর্যাদা অনেক কিছু ঠুনকো।
মাঝে করোনা মহামারির সময় একটা ক্লাউড কিচেন খুলেছিলাম। সেই সময়ের কিছু গল্পও ঝুলিতে আছে। সে আরেকদিন হবে ক্ষণ।
আজ যখন বাচ্চারা অনেকটা বড়, তাদের আলাদা জগত হচ্ছে। এখন আর মাকে সর্বক্ষণ পাশে প্রয়োজন হয় না। বেশ সাবলম্বী তারা। মনে হচ্ছে এবার কাজে ফিরি আবার। বাচ্চারাও চায় মা কাজে ফিরে যাক। কিন্তু মাঝে এতোটা সময় বয়ে গেছে, নিজের মধ্যে কেমন এক দ্বিধা। মানিয়ে নেয়ার দ্বিধা; সব সেই আগের মতো সামলে নিতে পারব কী না সেই দ্বিধা। তবে এও জানি সব দ্বিধা কাটিয়ে একটু সাহস করতে হবে শুধু। এখন দিন গুনছি নিজের আরাম বলয় ত্যাগ করে কবে একটু সাহস জাগবে মনে সেই দিনটির।
মাহবুবা ডিনা, সাংবাদিক ও লেখক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার পাঠ শেষে পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকেই। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে কাজ করেছেন একটানা ১১ বছর।