বাচ্চাদের ‘জয়-পরাজয়ের’ স্বাদ কেন গুরুত্বপূর্ণ?

প্রতীকী। ছবি: পিক্সাবে’র সৌজন্যে
প্রতীকী। ছবি: পিক্সাবে’র সৌজন্যে

নব্বইয়ের দশকের শিশুরা কীভাবে জয়ে উদযাপন বা পরাজয়ে বিষণ্ন হয়ে পড়তো সে গল্পের শেষ নেই। এমনও হয়েছে প্রতিযোগী দুই দলে খেলতে নেমে ‘দুই ভাই’ প্রতিদ্বন্দ্বিতার উত্তাপে রক্তের সম্পর্কের কথা ভুলে গিয়েছে। খেলা শেষে হাত মেলানোর মতো স্বাভাবিক সৌজন্য প্রকাশও ছিল বাহুল্য। তার পরিবর্তে কাঁদতে কাঁদতে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে।

আইস হকির একটি ছোট্ট মেয়েকেও দেখা গেছে রাগে ক্ষোভে প্রতিপক্ষের কোনো খেলোয়াড়কে লাথি মারছে। এমনটিও দেখা গেছে, দল হেরে যাওয়ায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে বরফের উপর উপুর হয়ে শুয়ে মুখ লুকাতে কোনো শিশুকে।

কথায় আছে, খেলাধুলা শুধু শারীরিক ‘ফিটনেস’ বাড়ায় না, ‘টিমওয়ার্ক’ ও শৃঙ্খলার মতো মূল্যবান বিষয়গুলোর শিক্ষাও দেয়। জীবনের পথে পথে ছড়িয়ে থাকা নানা ‘চ্যালেঞ্জ’ মোকাবেলার বুদ্ধিমত্তা তৈরি করে।

সে অর্থে জয় কিংবা পরাজয় বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ শিশুদের ভবিষ্যত প্রস্তুত করার পেছনে এর বিপুল অবদান।  

এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতামতও আলাদা কিছু নয়।

“জেতা এবং হারার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” বলেছেন ড. বিলি গারভে, যিনি শিশুর মানসিক বিকাশ ও আচরণগত সমস্যা নিয়ে কাজ করেন।

বাচ্চাদের জন্য, বিশেষ করে যাদের বয়স পাঁচ থেকে ১২ বছর, প্রতিযোগিতার উত্থান-পতনে মানিয়ে নিতে শেখা তাদের মানসিক গঠনের সোপান, বলেন তিনি।

তিন বছর বয়সী কন্যা শিশুর জনক গারভির বলেন, “যখন আমার মেয়ে হেরে যায়, তখন একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে চেষ্টা করি যে তার মধ্যে রাগ বা ক্ষোভের জন্ম নিচ্ছে কিনা। যদি এমনটি অনুভব করি তাহলে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি এ ধরনের অনুভূতি কেবল অনর্থক!”

“আমি তাকে হারতে শিখতে সাহায্য করি এভাবে যে, দ্যাখো তোমার ছোটভাই জয়ী হয়ে যারপরনাই আনন্দিত, আমি নিশ্চিত তার খুশি দেখে তোমারও ভালো লাগছে।”

“হতাশা সবসময় নিঃশর্ত ভালবাসা এবং সমর্থনের সাথে পরিপূরক হওয়া উচিত।

“যখন বাচ্চাদের পরাজয়কে মেনে নিতে শেখানো হয় তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের অনুভূতি তৈরি হয় যে জয়-পরাজয়ের মাধ্যমে তাদের মূল্য নির্ধারিত হচ্ছে না,” গারভে বলেন।  

ছবি: পিক্সাবে’র সৌজন্যে

আট বছরের কম বয়সী তিন সন্তানের জনক জর্ডান লুণ্ডের কথাই শুনি না কেন। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার খেলাধুলার প্রশিক্ষক।

তিনিও একটি বিষয়ে একমত যে বাচ্চাদের জয়-পরাজয়, প্রতিযোগিতার অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় ঘটানো জরুরি।

“বাচ্চারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পছন্দ করে। তাদের সতীর্থদের সাফল্যে কিংবা ব্যর্থতা তাদের মধ্যে ভালো বা খারাপ লাগার অনুভূতি তৈরি করে।”

এখনকার কোচরা শিশুদের আত্মবিশ্বাসী হতে শেখান, এটা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মানসিক গঠনের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করেন।

“এর অর্থ, বাচ্চাদের প্রাণবন্ত রাখতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিৎকার করা, কিংবা যারা অল্পতেই ভড়কে যায় তাদের বিব্রত না করা।

“অবশ্য আশির দশকে আমাদের প্রশিক্ষকরা এতোটা সচেতন ছিলেন না,” বলেন লুন্ড।

অবশ্য কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ যুক্তি দিয়ে বলেন, শিশুদের জয়-পরাজয়ের অনুভূতি ওদের ক্ষুদ্র পেশাদার ক্রীড়াবিদদের মতো আচরণ তৈরিতে সাহাজ্য করে।

শিকাগো ভিত্তিক মানসিক দক্ষতার প্রশিক্ষক জ্যাকলিন এলিস বলেন, “সামগ্রিকভাবে খেলাধুলা ক্রমেই কঠিন প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে।

“অ্যাথলেটদের মধ্যে ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার প্রবণতা জটিলতর হয়ে উঠছে, কারণ অল্প বয়সে ভালো করার চাপ ওদের নিতে হচ্ছে।”

এলিস এটি জুনিয়র লিগের একজন পর্যবেক্ষক। তিনি বলেন, পরাজয় মেনে না নেওয়ার মতো ভাবনা বরং জয়কেই আনন্দহীন করে তুলতে পারে।

১৪ বছর বয়সী একজন ফুটবল খেলোয়াড়ের শারীরিক ভাষা বর্ণনা করে তিনি বলেন, “সে একটি গোল করে পেছনের দিকে হাঁটছিলো, আমি তাকে বললাম: ‘কী, কোন উদযাপন করবে না?’ এবং সে শুধু বললো: ‘গোল করা তো আমার কাজ। আমি কেন এটি উদযাপন করতে যাবো?

“এ ধরনের মানসিকতা তাদেরকে যেকোনো চেষ্টা করতেও অনুৎসাহী করে তুলতে পারে। এটা আমাদের কি শিক্ষা দিচ্ছে?” এলিস উল্টো প্রশ্ন করলেন।

“আমরা আমাদের কমফোর্ট জোন থেকে বের হতে ইচ্ছুক নই, এমনকি চেষ্টা করতেও রাজি নই।”

কানাডার অন্টারিওর ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া ও বিনোদন ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক রায়ান স্নেলগ্রোভ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে: “যুব খেলাধুলার ‘পেশাদারীকরণের’ একটি কারণ হল বাচ্চারা খেলাধুলার প্রতি তাদের উৎসাহ হারাচ্ছে৷

অ্যাসপেন ইনস্টিটিউটের প্রজেক্ট প্লে যে তথ্য দেয় তাতে অনুমেয় শিশুরা দলগত উদযাপনের প্রতি আকর্ষণ হারাচ্ছে।

২০০৮ সালের ৪৫ শতাংশ থেকে এ ধরনের খেলায় অংশ নেওয়াদের হার ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৭ শতাংশ।

কানাডা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলিতেও এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্সের ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, ৭০ শতাংশ শিশু ১৩ বছর বয়সে খেলাধুলা ছেড়ে দেয়।

“শিশুরা বলে: ‘আমি খেলা বন্ধ করে দিয়েছি কারণ ওতে এখন আর আমার আকর্ষণ নেই,” স্নেলগ্রোভ বলেন৷

দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে

আরও পড়ুন