রাষ্ট্র সংস্কারে ১০ দফা প্রস্তাব দিলো একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী জামায়াতে ইসলামী। অবাক হইনি। পত্রপত্রিকায় এনিয়ে আলাপ হলো না, কেউ টুশব্দটি করলো না, স্বাভাবিকই লাগছে বরং।
কেউ কি লক্ষ্য করেছেন একটি পক্ষ আজ ‘প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনী পদ্ধতির’ কথা বলছেন। ভাবছেন খুবই ভালো প্রস্তাব, বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে তো এই পদ্ধতি অনুসরণ হয়ে আসছে, তাহলে বাংলাদেশে নয় কেন? জামায়াতই বা কেন চাইছে এমন? সে প্রসঙ্গে ঢোকার আগে আমরা বুঝে নেই প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনী পদ্ধতিটা আসলে কি।
জেনে থাকবেন এই নির্বাচন ব্যবস্থায় শতকরা ভোটের হিসেবে দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন হয়। ব্যাখ্যা করে যদি বলি, ধরুন আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০ শতাংশ ভোট পেল, আর বিএনপি পেল ৪০, জাতীয় পার্টি ১৫, জামায়াত ৭ আর অন্যান্য ছোটদলগুলো বাকি ৮ শতাংশ। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ পাবে ৯০ আসন, বিএনপি ১২০, জাপা ৪৫, জামা*য়াত ২১, অন্যান্যরা ২৪ আসন পেয়ে যাবে।
জামায়াত এই বিষয়টিই হয়তো চাচ্ছে যাতে করে সংসদে তাদের গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়। তাছাড়া এই ব্যবস্থায় ‘কোয়ালিশন’ সরকারের কোনো বিকল্প নেই, ছোট দলগুলো বরং খেলবে বড় দলগুলোকে নিয়ে!
লক্ষ্য করে দেখবেন জামায়াতের ভোটের অংশীদারিত্ব ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে কমেছে ধারাবাহিকভাবে।
১৯৯১ সালে তারা ১২.১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, যা ছিল তাদের সর্বোচ্চ অর্জন। তবে এরপর থেকে তাদের জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমেছে।
১৯৯৬ সালে ভোটের হার নেমে আসে ৮.৬%, এবং ২০০১ সালে আরও কমে দাঁড়ায় ৪.২৮%। যদিও ২০০৮ সালে ভোটের হার সামান্য বেড়ে ৪.৬% হয়, তবে এটি দলটির সামগ্রিক দুর্বলতারই চিত্র।
রাজনীতির মূলধারায় প্রাসঙ্গিকতা হারানোর পাশাপাশি, ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ দলটির জনসমর্থনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলেই ধারণা। নিজেদের ললাটে লেপ্টে থাকা এই কালিমা থেকে মুক্তি পেতে তাদের কার্যক্রম ছিলো নীরবে।
ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি সর্বশেষ সরকার পতনে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কালিমা লেপনে তারা কতোটা সফল। এখন আর ’রাজাকার’ গালি নয়, কারো কারো কাছে বরং ‘পেয়ারের’ পাত্র!
প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতিতে সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো বাংলাদেশে কোনো দলের পক্ষে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া রীতিমতো অসম্ভব। যার ফলে ছোট দলগুলোর চাহিদা মেনে নিতে গিয়ে বড় দলগুলোকে তাদের নীতিতে ছাড় দিতে হবে সর্বোচ্চ।
তাছাড়া যদি কোনো ছোট দল সমর্থন দেওয়ার পর তাদের সমর্থন তুলে নেয়, সেক্ষেত্রে সরকার ভেঙে যাবে, এবং নতুন করে আবার নির্বাচন করতে হবে।
ফলে সরকারে থাকা মূল দলকে সব সময়ই নীতিগত ভারসাম্য বজায় রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। লেজ নাড়াবে মাথা- এমন অবস্থা তৈরি হওয়ার শঙ্কাই প্রকট!
মোটা দাগে আরেকটি বড় সমস্যা হলো, যেহেতু ছোট দলগুলো কিছু আসন পেয়ে যাবে, এমনকি যদি তারা খুব কম ভোট পায় তারপরও। এতে চরমপন্থী, মৌলবাদী দলগুলোও কিছু আসন জিতবে।
সেক্ষেত্রে তাদের চরমপন্থী মতবাদ প্রচারে আর কোনো বাধা থাকবে না। যেমন জামায়াত মাত্র ৭ শতাংশ ভোট পেলেও কিন্তু ২১টি আসন নিয়ে অংশীদার হয়ে যেতে পারে সরকারে।
সত্যি বলতে আমি খুব বেশি অপলাপ বা প্রলাপে অভ্যস্ত নই! এর চেয়ে ঢের ভালো শীতের রাতে দূরের কোনো কফিশপে গিয়ে এক কাপ কফি পান, নিজের সঙ্গে আড্ডা কিংবা নতুন কোনো বিষয় নিয়ে ভাবা।
নেহায়েত সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত অন্তর্মুখী মানুষ বলা চলে আমাকে। তবে এতটুকু বলে রাখি, বহুগামী মানসিকতা নিয়ে সুখকে বন্দি করার মানুষ আমি নই!
বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটবে সে পরিকল্পনার জন্য বহু মতকে যুক্ত করা যায়, বহু পথকে আগলে ধরা যায়, তবে এটা কতোটা প্রাসঙ্গিক যে, দেশের স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীরা আজ আমাদের পথ বাতলে দেওয়ার দুঃসাহস দেখাবে!
কেউ একজন ক্ষমতায় বসে ’রিসেট বাটন’ চেপে একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, আর বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলতে চাইবে!
বাংলাদেশের মানুষ এতোটা বধির, বোবা হয়ে যায়নি, অন্ধ হয়ে যায়নি এখনও যে চাপিয়ে দেওয়া ‘বিচার’ মেনে নেবে। অসংখ্য অন্তর্মুখী মানুষ হয়তো অপেক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার!