জাপানে যে কারণে কমছে জনসংখ্যা

জন্মহার, কর্মশক্তি দেশটির অর্থনীতির উপরও প্রভাব ফেলছে।
জন্মহার, কর্মশক্তি দেশটির অর্থনীতির উপরও প্রভাব ফেলছে।

জাপানে শিশুদের জনসংখ্যা কমতে কমতে তলানিতে এসে পৌঁছেছে, যে ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে টানা ৪৪ বছর। নিম্ন জন্মহার ও দ্রুত বার্ধক্যের চক্রে দেশটি বর্তমানে এক মারাত্মক সংকটের মুখোমুখি।

জাপানের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের এপ্রিল ১ তারিখে ১৪ বছর ও এর কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ছিল মাত্র ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার, যা আগের বছরের তুলনায় ৩ লাখ ৫০ হাজার কম।

একই বছর জাপানের মোট জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৩৪ লাখ, যার মধ্যে শিশুর সংখ্যা মাত্র ১১.১%। আগের বছরের তুলনায় এই হারও সামান্য কমেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৩ সালে শিশুদের অনুপাত ছিল ২১.৭% এবং ২০২৪ সালে চীনে ১৭.১%।

আর জনসংখ্যার এই আনুপাতিক ধারা জাপানের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর ধরে দেশটির সরকার তরুণদের বিয়ে ও সন্তান নেওয়ার বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে এলেও জন্মহারে এর তেমন একটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।

জাপানে বর্তমানে নারীদের গড় সন্তান জন্মদানের হার ১.৩, যা স্থিতিশীল জনসংখ্যা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ২.১ এর চেয়ে অনেক কম।

দীর্ঘদিন ধরেই দেশটিতে মৃত্যুহার জন্মহারকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এতে মোট জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে শ্রমবাজার, অর্থনীতি, সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা ও সামগ্রিক সামাজিক কাঠামোতে।

২০২৪ সালে দেশটিতে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১৬ লাখ ২০ হাজার মানুষের, যা জন্মের চেয়ে দ্বিগুণ। বিয়ের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার বাড়লেও বিচ্ছেদের সংখ্যাও বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এই জনসংখ্যা হ্রাসের হার দেশটিতে অনেকটাই অপরিবর্তনীয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাপানকে বয়স্কদের দেশ বললেও ভুল হবে না, যেখানে ২০% এর বেশি মানুষের বয়স ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে।

কর্মব্যস্ত জাপানের একটি শহরের মূল সড়কের দৃশ্য।

২০২৪ সালে জাপানে মোট জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৩৪ লাখ। অবশ্য বর্ধিত মৃত্যুহার এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলে ২০৬৫ সালের মধ্যে জনসংখ্যা কমে দাঁড়াতে পারে মাত্র ৮ কোটি ৮৮ লাখে।

প্রশ্ন হলো কেন দেশটির যুবক যুবতিদের মধ্যে বিয়ে নিয়ে এই অনিহা বা সন্তান জন্মদানে বিমুখ আচরণ? বিশেষজ্ঞরা বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন, যার মধ্যে জীবন ধারণের ব্যয় বৃদ্ধি, স্থবির অর্থনীতি ও মজুরি, জায়গার অভাব এবং চরম কর্মসংস্কৃতি দেশটির ভবিষ্যতকে সংকটের দিকে ধাবিত করেছে।

জাপানের ওভারটাইম ও ওয়ার্ক-প্রেশার সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। অনেক কর্মী দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য হন এবং এর চাপে সন্তান নেওয়ার চিন্তা থেকে বিরত থাকেন।

দুর্বল ইয়েন, অর্থনৈতিক মন্দা এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় জনগণের মধ্যে অসন্তোষও বেড়েছে।

তবে দেশটির সরকার ইতিমধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে, জন্মহার বাড়াতে ও বিয়ে উৎসাহিত করতে নতুন একটি সরকারি সংস্থাও গঠিত হয়েছে। তারা শিশু পরিচর্যার সুবিধা বাড়ানো, বাবা-মায়ের জন্য আবাসন ভর্তুকি এবং কিছু কিছু শহরে সন্তান নেওয়ার জন্য নগদ প্রণোদনার মতো বিভিন্ন উদ্যোগ চালু করেছে।

জাপানের পাশাপাশি চীন, হংকং, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়াও জনসংখ্যা হ্রাসের সমস্যায় ভুগছে। ইউরোপের কিছু দেশ যেমন স্পেন ও ইতালিও একই সমস্যার মুখোমুখি, তবে তারা অভিবাসনের মাধ্যমে এই সংকট অনেকটাই সামাল দেওয়ার চেষ্টা জারি রেখেছে।

মজার বিষয় হলো, জাপানের প্রতিবেশী দেশ চীনও যে একই পথে হাঁটছে তা তাদের সর্বশেষ আদমশুমারিতে উঠে এসেছে। বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার এই দেশটিতে ২০২৪ সালে টানা তৃতীয়বারের মতো জনসংখ্যা কমেছে, যেখানে মৃত্যু সংখ্যা জন্মকে ছাড়িয়ে গেছে। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে জনসংখ্যার দিক থেকে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে ভারত।

তথ্যসূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি ও রয়টার্স

আরও পড়ুন