ইরানের পক্ষে কেন বাংলাদেশে বিক্ষোভ হয় না

গত ১৩ এপ্রিল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘মার্চ ফর গাজা’ সমাবেশে রাজনৈতিক নেতাদের পাশে ইসলামি বক্তারাও ছিলেন।
গত ১৩ এপ্রিল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘মার্চ ফর গাজা’ সমাবেশে রাজনৈতিক নেতাদের পাশে ইসলামি বক্তারাও ছিলেন।

মিজানুর রহমান আজহারী বাংলাদেশের একজন ইসলামি বক্তা; ওয়াজের বাজারে বেশ জনপ্রিয়ও তিনি। ফেইসবুকে তার পেইজে অনুসারীর সংখ্যাটিও বেশ বড়, ৭৯ লা্খ।

গত ১৩ এপ্রিল আজহারী তার পেইজে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন; সেখানে লিখেছিলেন, “গতকাল ঢাকার চারদিক থেকে তেজদীপ্ত মানব প্লাবনের উত্তাল তরঙ্গ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক মোহনায় মিলিত হয়েছিল। এটি শুধু একটি মার্চ ছিল না, ছিল বিবেকের ডাক! ন‍্যায়ের পক্ষে ইমানি হাজিরা …”

তার আগের দিনের এক সমাবেশ নিয়ে তার সেই পোস্ট। আগের দিন সেই সমাবেশের ছবিও পোস্ট দিয়েছিলেন আজহারী। ‘মার্চ ফর গাজা’ শিরোনামের সেই সমাবেশে তিনি বক্তৃতাও করেন।

‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মের ডাকে এই কর্মসূচি ডাকা হয়েছিল ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদে। মূলত ইসলামি দলগুলোর নেতারাই ছিলেন এই সমাবেশের নেপথ্যে।

জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন বিএনপি, এনসিপি নেতারাও। আজহারীর মতো ইসলামি বক্তারা সেই সমাবেশে মঞ্চে থেকে বক্তব্য রাখেন।

আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সেই সমাবেশের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। তাতে গাজায় ইসরায়েলি হামলা ঠেকাতে মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল- “আমরা বিশ্বাস করি, ফিলিস্তিন কেবল একটি ভূখণ্ড নয়—এটি মুসলিম উম্মাহর আত্মপরিচয়ের অংশ …. ইসরায়েল একটি অবৈধ, দখলদার, গণহত্যাকারী রাষ্ট্র, যা মুসলিমদের প্রথম কিবলা ও একটি পুরো জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।”

সেই সমাবেশে অংশগ্রহণকারী ইসলামি দল ও সংগঠনগুলোর কর্মীদের স্লোগানে ছিল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক।

ইসরায়েলি হামলায় তেহরানে বিধ্বস্ত একটি ভবন থেকে উদ্ধার করা হয় লাশ। ছবি: মেঘদাদ মাদাদি।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েল, তাতে এই পর্যন্ত অর্ধ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

তার প্রায় দুই বছর পর মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি মুসলিম দেশ এখন ইসরায়েল দ্বারা আক্রান্ত। গত ১৩ জুন ইরানে তাদের হামলা শুরু হয়। এক সপ্তাহ পর ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইরানে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও।

গাজায় অভিযানের ক্ষেত্রে ইসরায়েল যুক্তি দেখায় যে ফিলিস্তিনি দল হামাস আগে হামলা করায় তার জবাব দিয়েছে তারা। কিন্তু ইরানের বেলায় ইসরায়েলই আগে আক্রমণকারী।

কিন্তু এই হামলা নিয়ে আজহারীর ফেইসবুক পেইজে কোনো পোস্ট নেই; এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালানোর পরও কিছু নেই। অথচ তিনি যে রাজনৈতিক পোস্ট দেন না, তা নয়। গত ২২ মেও তিনি এক পোস্টে লিখেছেন, “জাতীয় ঐক্য টিকিয়ে রাখতে সেক্রিফাইসিং মেন্টালিটি জরুরি। বিভাজনে কেবল অপশক্তির চক্রান্তই সফল হবে। ভুলে গেলে চলবে না— স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। শান্ত হোন, ঐক্যবদ্ধ থাকুন।”

চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলগুলোকে লক্ষ্য করে তার যে এই পোস্ট, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর আগে নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়েও পোস্ট দিয়েছেন তিনি।

শুধু আজহারীই নন, ইরানে হামলার বাংলাদেশের ইসলামি বক্তাদের পাশাপাশি দলগুলোরও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি। জামায়াতের ফেইসবুক পেইজে এনিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। অথচ গত ১৭ জুন মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা, দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করে একটি পোস্টও দেওয়া হয়েছে।

গাজার গণহত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে যেমন ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে, ইরানে হামলার পর সেই মাত্রায় না হলেও বিক্ষোভ হয়েছে ওয়াশিংটনে।

কিন্তু ইরানে হামলার পর বাংলাদেশে একটি শুক্রবার গড়িয়ে গেলেও কোনো ইসলামী সংগঠন বায়তুল মোকাররমে মিছিল নিয়ে দাঁড়ায়নি। হেফাজতে ইসলামকে রাস্তায় নামতে দেখা যায়নি।

তা দেখে একজন ফেইসবুকে লিখেছেন- “বুঝলাম না ইরানের পক্ষে বাংলাদেশের আলেম সমাজ বায়তুল মোকাররমে সামনে দাঁড়ায় না কেন? ফিলিস্তিনের বেলায় তো অনেক হুমকি-ধামকি দেখা গেল। তাহলে কি আমাদের আলেম সমাজের ঈমানে ঘাটতি আছে?”

হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ মামুনুল হক ‘মার্চ ফর গাজা’ সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিন্তু ইরানে হামলা নিয়ে তার কোনো রা নেই।

তিনি এখন কোথায়- খবর নিতে গিয়ে তার ফেইসবুক পেইজ থেকে জানা যায়, তিনি এখন রয়েছেন সৌদি আরবে। যেদিন ইরানে হামলা হলো, সেই ১৩ জুন রিয়াদে নিজ দল খেলাফত মজলিসের দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ছিলেন তিনি।

মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরব-ইরানের যে দ্বন্দ্ব এ যেন তারই প্রতিচ্ছবি।

ইসলাম ভ্রাতৃত্বের কথা বললেও মুসলিম বিশ্ব শিয়া-সুন্নিতে বিভক্ত; মধ্যপ্রাচ্যে তা আরও প্রকট। সুন্নি অধ্যুষিত সৌদি আরব মুসলিম উম্মার নেতৃত্বের আসনে থাকলেও তাদের প্রতি বরাবরই চ্যালেঞ্জ আসছে শিয়া প্রধান দেশ ইরানের কাছ থেকে।

সেই কারণে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সৌদি আরব ও ইরান দুই বলয়ে। আর নিজের বলয় শক্তিশালী করতে নানা মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলোতে নানা পর্যায়ে অর্থ পাঠিয়ে থাকে সৌদি আরব, যেটা ইরানের কাছ থেকে আসে না।

এই কারণেই সুন্নিপ্রধান বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ইসলামি নেতারা সৌদি আরবের বিরাগভাজন হওয়ায় শঙ্কায় ইরানের পক্ষে দাঁড়াতে চান না বলে ধারণা করা যায়। অর্থ্যাৎ সৌদি প্রেমের সঙ্গে অর্থ-যোগও রয়েছে। 

তবে তারা না দাঁড়ালেও বাংলাদেশের সোশাল মিডিয়ায় ইরানের পক্ষে ঝড় উঠেছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী প্রচার-অপপ্রচার দুটোই চলছে সমানতালে।

এরমধ্যে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির প্রতিরোধের শপথ নিয়েও চলছে শিয়াদের নিয়ে সমালোচনা।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুমকির জবাবে খামেনি হজরত আলীর নামে শপথ করে বলেছিলেন, “মহান হায়দারের নামে যুদ্ধ শুরু হলো।”

খামেনির ওই বক্তব্য শিরক প্রমাণে ব্যস্ত একদল। তাদের কথা হলো, আল্লাহর নাম না নিয়ে আলীর নাম কেন নিলেন খামেনি।

তার পাল্টায় অনেকে লিখছেন- “ইরানে ইসরাইল-মার্কিন আগ্রাসন ও বোমাবাজির প্রতিবাদ না করে আপনি যদি শিয়া-সুন্নি হিসাব করতে থাকেন, তাহলে আপনার মধ্যে গলদ আছে।”

রোববার ভোরে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ছবি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিও থেকে নেওয়া।

প্রবাসী সাংবাদিক মারুফ মল্লিক এক পোস্টে লিখেছেন, “যারা বলবে ইরান সিরিয়াতে সুন্নিদের মারছে, বুঝে নেবেন তারাই ইসরায়েলের এজেন্ট। এটা মূলত একদল দাড়ি-টুপিধারী আপাত মোল্লা মনে হওয়া লোকদের দিয়ে বলানো হচ্ছে যেন সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে ও বিভ্রান্ত হয়। ইসলামের পরিভাষায় এই মোল্লারা মুনাফিক।

“ইরান মূলত রাশিয়ার সহায়তা নিয়ে সিরিয়ায় ইসরায়েলের ও টার্কিশ এজেন্টদের দমন করছে। সুন্নি পরিচয় হিসাবে কাউকে দমন করেনি ইরান। ধর্মীয় পরিচয়ে না, লড়াই হয়েছে রাজনৈতিক অবস্থানের। কিন্তু ইসরায়েল ও টার্কিশরা সালাফি, ওয়াহিবি এজেন্টদের দিয়ে ধর্মীয় ও বিভাজনের কার্ড খেলছে।”

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরব অবশ্য ইরানে হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তবে নরম ভাষার ওই বিবৃতিতে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজার আহ্বান জানানো হয়েছে।

আবার যুক্তরাষ্ট্র হামলার চালানোর পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি গিয়েছিলেন তুরস্কে; সেখানে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ান তাকে পরামর্শ দিয়েছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপস করে নিতে।

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর কড়া নিন্দা সবার আগে জানিয়েছে যে দেশগুলো সেই চীন, কিউবা, ভেনেজুয়েলা, উত্তর কোরিয়া সবক’টিই কমিউনিস্ট শাসিত। যুক্তরাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসাবে দেখে তারা। তাই মুসলিম-খ্রিস্টান বিচার না করে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার নিন্দা জানিয়েছে তারা।

বাংলাদেশেও ইসলামী দলগুলো যখন নিশ্চুপ, তখন ইরানে হামলার নিন্দা জানিয়েছে বাম দলগুলো। তারা যেভাবে গাজায় হামলার নিন্দা জানিয়েছে, ইরাকে হামলার নিন্দা জানিয়েছিল, সেভাবেই।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন