হঠাৎ কেন গাজা দখলের কথা বলছেন ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ড দখলের একটি বিতর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ড দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা তুলে ধরেন ট্রাম্প। তিনি জানান, তার দেশ গাজা দখলে নিয়ে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করবে।

ট্রাম্পের এই প্রস্তাব নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তার এই বিতর্কিত পরিকল্পনার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে এবং এটি কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়েও চলছে আলোচনা। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে।

গাজা নিয়ে ট্রাম্পের প্রস্তাবে কী আছে

ট্রাম্প গত ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই গাজা ভূখণ্ডকে একটি “অসাধারণ স্থান” হিসেবে উল্লেখ করেন, যেখানে তার মতে”সুন্দর কিছু করা যেতে পারে”।

এরপর ২৬ জানুয়ারি এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি ফিলিস্তিনিদের মিশর ও জর্ডানে স্থানান্তরের প্রস্তাব দেন, যাতে গাজা “পরিষ্কার” করা যায়। তার এই মন্তব্য ফিলিস্তিনিদের স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে উচ্ছেদের ইঙ্গিত দিয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

তবে গত মঙ্গলবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে হোয়াইট হাউসে এক বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজা দখল করবে এবং সেখানকার ফিলিস্তিনিদের “অন্য দেশে চলে যেতে” উৎসাহিত করবে।

তার এই বক্তব্যকে অনেকেই গাজার ফিলিস্তিনিদে জাতিগত নির্মূলের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন।

ট্রাম্পের উদ্দেশ্য কী

ট্রাম্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য বোঝা বেশ কঠিন। তিনি নিজেকে একজন দক্ষ আলোচক মনে করেন এবং প্রায়ই তার বক্তব্যের আসল অর্থ অস্পষ্ট থাকে। গাজা নিয়ে সর্বশেষ যে পরিকল্পনার কথা তিনি জানিয়েছেন, তার পেছনে কৌশলগত উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক জাসমিন এল-গামালের মতে, “ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বোঝার চেষ্টা করা বৃথা। তার মাথায় কী আছে, তা কেউ জানে না।” তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র গাজায় গিয়ে মানুষকে উচ্ছেদ করে সেখানে বিশ্বের মানুষকে বসবাসের জন্য আমন্ত্রণ জানাবে– এটি সম্পূর্ণ অবাস্তব।”

যুদ্ধ বন্ধ হওয়ায় গাজার উত্তরাঞ্চলে ফিরছে ফিলিস্তিনিরা। ছবি : আনাদোলু

কেউ কেউ আবার মনে করছেন, ট্রাম্পের এই ঘোষণা ইসরায়েলের ডানপন্থী গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা হতে পারে, যারা গাজায় অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনের পক্ষে। এ ছাড়া, এটি আরব দেশগুলোকে গাজা পুনর্গঠনে অর্থায়নে বাধ্য করার কৌশলও হতে পারে।

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ মনে করেন, “এই ঘোষণা পুরো অঞ্চলকে তাদের নিজস্ব সমাধান নিতে উৎসাহিত করবে।”

গাজা দখলের পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত

ট্রাম্পের গাজা দখলের পরিকল্পনা তার সমর্থকদেরও হতবাক করেছে। রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের মতো ব্যক্তিরাও গাজায় মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করছেন। এ ছাড়া, গাজায় বসবাসকারী ২০ লাখে বেশি ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদের ধারণা বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

গাজার যুদ্ধের সময় দক্ষিণে স্থানান্তরিত হওয়া লাখো ফিলিস্তিনি যুদ্ধ বন্ধের পর পুনরায় উত্তর গাজায় ফিরে গেছে, যা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থানকে প্রতিফলিত করে।

বিশ্লেষকদের মতে, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের যেকোনো প্রচেষ্টা সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হবে। ইসরায়েল ১৫ মাস ধরে গাজায় ব্যাপক হামলা চালালেও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে পারেনি। বরং হামাস তাদের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছে এবং নতুন যোদ্ধা নিয়োগ দিয়েছে  বলে খবর মিলছে।

আরব মিত্রদের অবস্থান কী

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা ট্রাম্পের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছে। সৌদি আরব, মিশর ও জর্ডানের মতো দেশগুলো এই পরিকল্পনাকে অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা দিয়েছে। ট্রাম্প গাজা দখলের পরিকল্পনা জানানোর পরপরই বিবৃতি দিয়ে সৌদি আরব এটি প্রত্যাখ্যান করার কথা জানায়।

জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহর আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার কথা। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে তার বৈঠকের কথাও রয়েছে সফর করবেন, তবে গাজা থেকে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে আশ্রয় দেওয়ার যে প্রস্তাব ট্রাম্প করেছেন, তাতে তিনি রাজি হবেন কি না, তা অনিশ্চিত।

অবশ্য হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ইঙ্গিত দিয়েছেন, জর্ডানের বাদশাহ ট্রাম্পের প্রস্তাব মেনে নিতে পারেন।

গাজা দখলের ধারণা নতুন কি

ইসরায়েলি রাজনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে গাজা দখলের স্বপ্ন দেখে আসছে। ২০০৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন গাজা থেকে ইহুদি বসতি স্থানান্তর করলেও ইসরায়েল গাজার আকাশসীমা ও প্রবেশপথ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।

১৫ মাসের যুদ্ধে গাজা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।

গাজার যুদ্ধের শুরুতে ইসরায়েলের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ের একটি গোপন নথিতে ফিলিস্তিনিদের মিশরের সিনাই মরুভূমিতে স্থানান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছিল। নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে এই ধারণাকে প্রশ্রয় দেননি, তবে তার সমর্থকরা এই প্রস্তাবকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

ট্রাম্পের লাভ কী

ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার, যিনি একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী, গত মার্চে গাজার ফিলিস্তিনি জনগণকে উচ্ছেদ করে সেখানে উন্নয়নের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “গাজার সমুদ্রতটের সম্পত্তি খুব মূল্যবান হতে পারে।”

ট্রাম্পও গাজার উন্নয়নের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি উপেক্ষা করে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কতটা ন্যায্য, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

হামাস নির্মূলের লক্ষ্য কি ট্রাম্পের পরিকল্পনার অংশ

হামাস নির্মূলের কথা প্রায়ই ইসরায়েলের যুদ্ধের উদ্দেশ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরায়েলের প্রকৃত উদ্দেশ্য ভিন্ন। রাজনৈতিক পরামর্শক সামি হামদি বলেন, “হামাস সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের ধারণা হামাসের চেয়েও পুরোনো।”

ট্রাম্পের গাজা দখলের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। কেননা এই প্রস্তাব এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছে।

এ ছাড়া ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অধিকারকে উপেক্ষা করে এই পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়া হলে তা আরও সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে বলেও মনে করছেন তারা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads