পোপের মৃত্যুর পর যে কারণে নষ্ট করে ফেলা হয় তার আংটি

pope ring

তেরশ’ শতকের গোড়ার দিকের ইতিহাসের কারণে ‘ফিশারম্যান’স রিং’ ক্যাথলিক পোপের পরিচিত প্রতীকগুলোর একটি হয়ে ওঠে। এই আংটির নাম রাখা হয়েছে সেন্ট পিটারের নামে। তিনি ছিলেন একজন জেলে এবং ক্যাথলিক বিশ্বাস অনুযায়ী তিনিই প্রথম পোপ। 

পোপ ফ্রান্সিস তার ১২ বছরের সময়কালে এই আংটি নানা অনুষ্ঠানে পরতেন। অসংখ্য ভক্ত এই আংটিতে চুমু খেয়েছেন। এমনকি আংটিতে চুমু খাওয়া নিয়ে একবার স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

প্রথা অনুযায়ী পোপের মৃত্যুর পর এই সিল-মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত আংটি ভ্যাটিকানের ভেতরেই ধ্বংস বা অন্তত বিকৃত করা হবে। এবারের ঘটনায়, ৮৮ বছর বয়সে ইস্টার মান্ডের দিন মারা যাওয়া পোপের আংটিরও সেই পরিণতি হবে।

এই রীতি শুধু ধর্মীয় নয়, বাস্তব কারণেও প্রচলিত হয়েছে। ফিশারম্যান’স রিং এবং একটি ঝোলানো ধাতব সিল (যার নাম ‘বুল্লা’) ঐতিহ্যগতভাবে পোপের অফিসিয়াল চিঠি ও দলিলে সিল দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো। 

প্রত্যেক নতুন পোপের জন্য নতুন রিং ও বুল্লা তৈরি করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। পোপের মৃত্যুর পর এসব উপকরণ ব্যবহার করে কেউ যেন তার নাম ব্যবহার করে জাল চিঠি বা নির্দেশ জারি করতে না পারে, সেজন্য ওই আংটি ও বুল্লা হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলা হতো। ১৫২১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এ নিয়ম কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়।

সিএনএন-এর ভ্যাটিকান সংবাদদাতা ক্রিস্টোফার ল্যাম্ব একে তুলনা করে বলেছেন, “এটা অনেকটা সোশাল মিডিয়ায় কারো একাউন্টের লগইন তথ্য মুছে ফেলার মতো। এর মূল উদ্দেশ্যই হলো—কেউ যেন জাল দলিলে মিথ্যা সিল ব্যবহার না করতে পারে।”

পোপের মৃত্যুর পর রোমান ক্যাথলিক চার্চের অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব পালন করছেন ক্যামেরলেনগো পদের একজন জ্যেষ্ঠ কার্ডিনাল। প্রথা অনুযায়ী তিনি পোপের মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়ার পর কার্ডিনালদের সামনে রিং ও বুল্লা ধ্বংস করেন।

এই রীতি বহু বছর ধরে চলে আসছে। এমনকি যখন এই জিনিসগুলো আর অফিসিয়াল সিল হিসেবে ব্যবহারও করা হতো না তখনও এই রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। ১৯শ শতকের মাঝামাঝিতে রেওয়াজে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তখন আধুনিক স্ট্যাম্প ব্যবহারের প্রচল শুরু হয়। কিন্তু যখন পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শ ৬০০ বছরের মধ্যে প্রথমবার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন, তখন একটি নতুন রীতি চালু হয়। সেই রীতিতে আংটির গায়ে একটি গভীর ক্রস চিহ্ন খোদাই করে দেওয়া হয়।

অবশ্য ক্রিস্টোফার ল্যাম্ব মনে করেন, আংটি ধ্বংস করার প্রয়োজন নেই। কারণ পোপ সেজে জালিয়াতি করার সম্ভাবনা এখন অনেকটাই কমে গেছে।

বর্তমানে ক্যামেরলেনগো পদে আছেন কার্ডিনাল কেভিন জোসেফ ফারেল। তিনি আয়ারল্যান্ডের নাগরিক এবং ২০২৩ সালে পোপ ফ্রান্সিস তাকে এই দায়িত্বে নিয়োগ দিয়েছেন। 

ধারণা করা হচ্ছে, তিনি আগের নিয়ম মেনে রিংটি ক্ষতিগ্রস্ত করবেন পোপ নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর আগেই। এই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘পাপাল কনক্লেভ’। এর মাধ্যমে পরবর্তী পোপ নির্বাচন করা হয়।

ফিশারম্যান’স রিং অনেক রীতিনীতি ও প্রতীকী গুরুত্ব বহন করলেও এই আংটির ব্যবহার পোপভেদে ভিন্ন হয়ে এসেছে।

এই দিক থেকে পোপ ফ্রান্সিস তার পূর্বসূরিদের কিছুটা থেকে আলাদা ছিলেন। কেউ কেউ যেমন—পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শ—এই আংটি প্রতিদিন ব্যবহার করতেন। আবার পোপ জন পল দ্বিতীয় প্রায়ই এর পরিবর্তে পরতেন অন্য একটি আংটি, যা ছিল রিং-আকৃতির ক্রুশ বা এর অনুরূপ কিছু।

পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন মাঝামাঝি ধরনের। তিনি আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে ফিশারম্যান’স রিং পরতেন। কিন্তু প্রতিদিনের ব্যবহারেই তিনি একটি সাধারণ রূপার আংটি ব্যবহার করতেন। এই আংটি তিনি কার্ডিনাল জীবন থেকে ব্যবহার করেছেন।

পোপ ফ্রান্সিস সম্ভবত আংটিতে চুমু খাওয়া নিয়ে অস্বস্তি বোধ করতেন। ২০১৯ সালের শুরুতে একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ভক্তরা আংটিতে চুমু খেতে গেলে তিনি বারবার হাত সরিয়ে নিচ্ছেন। পরে ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি মূলত জীবাণুর বিস্তার ঠেকাতেই এমনটি করেছিলেন।

ক্রিস্টোফার ল্যাম্বের মতে, ফ্রান্সিস সবসময় মানুষকে তাদের অবস্থান অনুযায়ী গ্রহণ করতেন। তিনি বিপদে পড়া মানুষের সঙ্গে করমর্দন করতেন, কখনো আলিঙ্গন করতেন। তিনি কখনও চাইতেন না কেউ তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আংটিতে চুমু দেবে।

বিভিন্ন শতাব্দীতে ফিশারম্যান’স রিংয়ের নকশা ও রূপ ভিন্ন ভিন্ন ছিল। বেশিরভাগ রিংয়ে সেন্ট পিটার ও হলি সী’র চাবির প্রতীক আঁকা থাকে। এটি সেই মুহূর্তের স্মারক, যখন সেন্ট পিটারকে স্বর্গের চাবি প্রদান করা হয়েছিল। তবে এই আংটির নকশা নির্ধারণে নির্দিষ্ট কোনো কঠোর নিয়ম নেই। সে কারণে আংটির নকশায় অনেক সময় পরিবর্তনশীল ফ্যাশন বা সংশ্লিষ্ট পোপের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায়।

সাধারণত প্রত্যেক নতুন পোপের জন্য একজন সোনার কারিগর এই রিং প্রস্তুত করেন। তবে পোপ ফ্রান্সিস এই প্রচলিত রীতি অনুসরণ করেননি। 

ক্রিস্টোফার ল্যাম্বের মতে, তিনি একটি ‘পুনর্ব্যবহৃত‘ রিং পরতেন। বিনয়ী মনোভাব থেকে পোপ ফ্রান্সিস নতুন কোনো রিং তৈরি করতে বলেননি। বরং তিনি পোপ পল ষষ্ঠ-এর সচিবের ব্যবহৃত একটি পুরোনো রিং গ্রহণ করেছিলেন।

ভ্যাটিকানের ভাষায়, এই রিংটিকে বলা হয় ‘ইন-পজেশন রিং’। এটি একসময় আর্চবিশপ পাসকুয়ালে মাক্কি ব্যবহার করতেন, যিনি পোপ পল ষষ্ঠ-এর ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন এবং ২০০৬ সালে মারা যান। এই আংটি ছিল স্বর্ণ-পাতযুক্ত রূপার তৈরি। এটি খাঁটি সোনারও নয়।

তবে এই আংটির ভবিষ্যৎ কী হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো, পোপ নির্বাচনের গোপনীয় প্রক্রিয়া ঘিরে থাকা প্রশ্নগুলোর মধ্যে এটিও একটি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads