নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে তা নিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন শঙ্কা। জাতীয় নাগরিক পার্টির ‘হুঙ্কারের’ পর প্রধান উপদেষ্টার ‘নড়চড়’ বক্তব্যে ভোটের তারিখ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো রীতিমতো সন্দিহান। তাছাড়া আওয়ামী লীগহীন নির্বাচন কতোটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে সে প্রশ্নও সামনে আসছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচনই প্রকৃত অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারে না।
তাদের যুক্তি, আওয়ামী লীগের বিশাল কর্মী-সমর্থক গোষ্ঠী এবং দেশব্যাপী সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। এই দলটি নির্বাচনে অংশ না নিলে বিপুল সংখ্যক ভোটারের মতামত এবং অংশগ্রহণ অগ্রাহ্য করা হবে, যা নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।
এমন নির্বাচন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলেও কারো কারো অভিমত।
তবে ভিন্ন মতও শোনা গেছে বিগত দিনগুলোতে। তারা বলছেন, একটি নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট দলের অংশগ্রহণ অপরিহার্য নয়।
চলতি বছরের ১০ মে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেয় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার, যে সিদ্ধান্ত এসেছে মূলত নির্বাহী আদেশে। পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনও দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে।
আওয়ামী লীগহীন নির্বাচনের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্ভুক্তি নির্ভর করে নির্বাচন প্রক্রিয়া কতটা নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু তার ওপর। যদি সকল দলের জন্য সমান সুযোগ ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়, ভোটাররা অবাধে ভোট দিতে পারেন এবং নির্বাচন কমিশন ও সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে, তাহলে আওয়ামী লীগ ছাড়া হলেও অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং নাগরিকরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, যা নির্বাচনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারে।
তারা মনে করছেন, মূল লক্ষ্য হলো একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, যেখানে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে, এবং কোনো একটি দলের অনুপস্থিতি সেই প্রক্রিয়াকে অগণতান্ত্রিক করে তোলে না, যদি বাকি সব শর্ত পূরণ হয়।
উতুঙ্গ আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারে ‘বড় দায়িত্ব’ পেয়ে যাওয়া সুশাসনের জন্য নাগরিকের প্রতিষ্ঠাতা বদিউল আলম মজুমদার আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিষয়টিকে ‘আইনি প্রক্রিয়া’ হিসেবেই দেখছেন।
শনিবার এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল বলেন, সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। এখন তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা, সেটা সরকার ও নির্বাচন কমিশন আইনি প্রক্রিয়ায়ই সিদ্ধান্ত নেবে।
আওয়ামী লীগ ছাড়া আগামী নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে বলেও মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সরকারবিরোধী মুখ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই উন্নয়নকর্মী।
দুপুরে রাজধানীর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বদিউল আলম।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে এই বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে, সম্প্রতি সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা জাতীয় নাগরিক পার্টির এক নেতার বক্তব্যের রেশ না কাটতেই প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের একটি বক্তব্য ঘিরে নির্বাচন নিয়ে নতুন করে দেখা দিয়েছে সংশয়।
তবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো অনিশ্চয়তা দেখছেন না বলে মন্তব্য এসেছে বদিউলের কাছ থেকে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারও আন্তরিকভাবেই নির্বাচনের পথেই এগোচ্ছে। আশা করছি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের ভূমিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, সবাই যার যার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। দেশ গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাবে।
বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থাই তাকে স্বৈরাচারের পরিণত করেছে। এজন্যই সংস্কার পরিবার প্রয়োজন। নির্বাচন ব্যবস্থা পুরনো ব্যবস্থায় চললে নির্বাচন আবারও বিতর্কিত হবে। স্বৈরাচার সৃষ্টির পথ থেকে যাবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা থাকলেও দল, প্রার্থী ও ভোটারদের দায়িত্বশীল ভূমিকা ছাড়া গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়। কেন্দ্র দখল, প্রতিপক্ষের এজেন্ট ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করলে ৪০ হাজার কেন আরো বেশি বডি ক্যামেরা কিনে নিরাপত্তা জোরদার করলেও গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে না।
“এছাড়া নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন নিরপেক্ষ না থাকলে আগামী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার যে স্বপ্ন দেখছি তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে। অন্যদিকে নির্বাচনের প্রধান স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দলগুলো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।”
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের সময় ঘোষণা হলেও জুলাই সনদ চূড়ান্ত হয়নি। সনাতন না পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তা নিয়ে এখনো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ শেষ হয়নি। এ অবস্থায় জুলাই সনদে স্বাক্ষরসহ আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজন নিয়ে নতুনভাবে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
“আসন্ন নির্বাচন যদি সঠিক সময়ে করা সম্ভব না হয় তাহলে দেশ এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। তাই গণতন্ত্র, দেশ ও জাতির স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলকে যার যার অবস্থান থেকে ছাড় দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের গতিকে বেগবান করা উচিত।”
তিনি বলেন, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী দলগুলোর মধ্যে বিভেদের সুযোগ নিয়ে পরাজিত শক্তি দেশে অরাজকতা তৈরি করতে পারে। তবে কেউ কেউ দেশে ১/১১ ও গৃহযুদ্ধের যে জুজুর ভয় দেখাচ্ছে তা অমূলক।
এর আগে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাই প্রধান শীর্ষক ছায়া সংসদে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের বিতার্কিকরা অংশগ্রহণ করেন।
এ সম্পর্কিত আরও খবর: