ইউনূসের পরিণতি কি নূরুল হুদার মত হবে?

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ।

বাংলাদেশ ও বিশ্ব নিয়ে নিয়মিত লিখে আসছেন সিনিয়র সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ, যিনি সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন এনায়েতুল্লাহ খানের প্রখ্যাত সাপ্তাহিক হলিডে দিয়ে। এরপর সাংবাদিকতার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করে গেছেন কয়েকযুগ। সর্বশেষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ছিলেন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক হিসেবে। সাম্প্রতিককালে সোশাল মিডিয়ায় ‘মিডিয়া ওয়াচ’ শিরোনামে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজের মতামত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছেন এই অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। পাঠকের জন্য তার সর্বশেষ লেখাটি হুবুহু তুলে দেওয়া হলো।

গত দুদিন থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদাকে জুতোপেটা এবং জুতোর মালা পরিয়ে বিএনপির একদল লোক পুলিশের হাতে দিয়েছে।

ভিডিওতে দেখলাম বিএনপির এক নেতা তাকে জুতা দিয়ে মারছে। আর বলছে- এর কারণেই হাসিনার মত স্বৈরাচার দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেছে।

প্রথমে এটা দেখার পর আমি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেছি। আমি ঠিক বুঝতে পারিনি যে তাকে জুতোপেটা করা হচ্ছে। পরে যখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো ভাবলাম এদের তো এটাই প্রাপ্য। তখন মনে হল হয়তো এটা দেখে আমলা নামধারী সুবিধাবাদীরা ভবিষ্যতে সতর্ক হবে।

তারপর ভাবলাম পুলিশের সামনে এটা কীভাবে ঘটলো? এরপর দেখলাম অনেকেই মব কালচারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল উপদেষ্টা ফাওজুল করিম খান। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন এটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

আমার নিজেরও মতামত তাই। কিন্তু প্রশ্ন হল ফাওজুল খান তো ইউনূস সরকারের একজন উপদেষ্টা। এটা অবশ্য তার ব্যক্তিগত মতামত। তিনি যে একজন সৎ, নীতিবান মানুষ এই পোস্টে তার প্রতিফলন আবারো দেখলাম।

কিন্তু প্রশ্ন হল এই মব কালচার তো নতুন কিছু না। এটা শুরু হয়েছে এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই। পত্রপত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর খবর পাচ্ছি প্রায় প্রতিনিয়তই। (মব কালচার আমরা হাসিনার আমলেও দেখেছি)।

ফাওজুল সাহেবের প্রতিক্রিয়ায় আমার খালি একটাই কথা মনে হচ্ছিল যে ইউনূস সাহেব বা তার উপদেষ্টারা কি এতদিন এগুলো দেখতে পাননি? নাকি সবাই উট পাখির মত বালিতে মাথা গুঁজে বসেছিলেন? আরও স্পষ্ট করে বলি উপদেষ্টাদের মধ্যে কেউ কি কখনো এটার বিরুদ্ধে তাদের নিয়মিত বৈঠকের সময়ে এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন? কেউ যে বলেননি এটা তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কারণ এই কালচার তো থেমে নেই।

প্রশ্ন হল এই ভয়াবহ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আগে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন? নূরুল হুদার ঘটনার পর দেখলাম সরকার থেকে একটা গৎবাধা বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। আগের গুলোর মতই এবারও বলা হলো কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দেওয়া হবে না; এদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।

এই বস্তাপচা কথাগুলো শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষ এতই বিরক্ত যে এগুলো আর কোন গুরুত্ব বহন করে না।

প্রশ্ন হল ইউনূস সাহেব এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছেন না কেন? উত্তর খুবই সোজা। তার এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন সময় নেই। এতদিনে যেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি এরা আসলে দেশের কোন মঙ্গল করতে আসেনি। নিজেদের সুযোগ-সুবিধা ছাড়া এদের আর কোন প্রায়োরিটি আছে বলে মনে হচ্ছে না।

যদি থাকতো তবে সবার আগে অন্তর্বর্তী সরকার নজর দিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কেউ আইন ভঙ্গ করলে তাকে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা।

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে নির্লজ্জভাবে ইউনূস সাহেব নিজেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছেন এবং কোন আইন কানুনের ধার ধারছেন না। এটা দেখার পর অন্যান্যরা ভাবছে উনি যখন আইন কানুনের তোয়াক্কা করেন না, তাহলে আমরা আইন কেন মানবো?

তা না হলে একজন তথাকথিত দেশপ্রেমিক, নোবেল জয়ী মানুষ কীভাবে বিচার বিভাগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একের পর এক নির্বাহী আদেশে তার বিরুদ্ধে মামলা এবং অন্যান্য শাস্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এগুলোর ব্যাপারে আমি আগেও বিস্তারিত লিখেছি। তাই আর এটা ব্যাখ্যা করছি না। এটা আপনারা সবাই জানেন।

এছাড়াও দেখতে পেলাম তিনি শুধুমাত্র গ্রামীণ ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ দেখছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্যাংকের কর মওকুফ, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যানপাওয়ারের লাইসেন্স নেওয়া। আমার প্রায়ই মনে হয় তিনি যদি সত্যিকার অর্থে দেশের ভালো চাইতেন তবে এই ম্যানপাওয়ার ব্যবসায় যে সীমাহীন দুর্নীতি আছে সেটা দূর করার চেষ্টা করতেন। সেটা না করে তিনি এই লুক্রেটিভ ব্যবসায় কিভাবে ভাগ বসানো যায় সেটা মোটামুটি নিশ্চিত করেছেন।

তবে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ মনে হয় তার বিদেশ যাত্রায়। দশ মাসে এ পর্যন্ত ১১ বার তিনি বিদেশ ভ্রমণ করেছেন বিরাট লাট বহর নিয়ে। যেমনটা আমি আগেও লিখেছি যে এর কোনটাই দ্বিপাক্ষিক সফর ছিল না। তাকে কোন সরকার বা সংস্থা রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান হিসেবে দাওয়াত দেয়নি। এগুলো সবই ছিল তার ব্যক্তিগত সফর। তা সত্ত্বেও তিনি কোটি কোটি টাকা খরচা করে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন বিরাট সফরসঙ্গীদের নিয়ে। আমি প্রায়ই ভাবি তিনি তো এখন একটা সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। কিভাবে তিনি কেন গুরুত্বপূর্ণ দৈনন্দিন কাজকর্ম ছেড়ে বিদেশ ঘুরে বেড়ান? দেশের সব ক্ষেত্রে যে একটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছে সেটারও মনে হয় এটা একটা বড় কারণ। কোন এক ফেসবুক পোস্টে দেখলাম তিনি এ পর্যন্ত প্রায় দু মাস দেশের বাইরে থেকেছেন।

আপনারা হয়তো জানেন দ্বিপাক্ষিক আমন্ত্রণ হলে হোস্ট কান্ট্রি সব খরচ বহন করে। বাস্তবে দেখলাম এই গরিব দেশের ট্যাক্সপেয়াররা তার এই এক্সপেন্সিভ ভিজিট গুলো ফাইনান্স করেছে। সবচেয়ে ব্যথিত হয়েছি যখন দেখলাম লন্ডনে যেয়ে অত্যন্ত বিলাসবহুল হোটেল ডরচেষ্টারে থেকে প্রতিরাতে তার সুইটের জন্য দশ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন। এছাড়াও তার সফর সঙ্গী ৩৯ জনকে তিনি এই হোটেলে রেখেছেন। বিএনপি’র নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ ছাড়া আর কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা আমরা সেখানে লক্ষ্য করলাম না।

তার এই নির্লজ্জ, বিবেকহীন কাজগুলো ফ্যাসিলিটেট করার জন্য মনে হয় তিনি বিদেশ থেকে সূট-টাই ওয়ালা বেশ কয়েকজনকে ভাড়া করে এনেছেন। এরা সবাই তথাকথিত মেধাবী এবং যোগ্য। গত দশ মাসে এরা কতবার বিদেশে গিয়েছেন তার কোন হিসাব কোন পত্রপত্রিকায় দেখতে পেলাম না। কোন সাংবাদিক এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করে না।

আর আপনারা তো জানেন বিদেশ যাত্রা মানেই হল বিজনেস ক্লাস ট্রাভেল এবং ফাইভ স্টার হোটেল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো খলিলুর রহমান, লুৎফে সিদ্দিকী, আশিক চৌধুরী, আহসান মনসুর এবং ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব। মাঝে মাঝে প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে বিদেশে এরা কার সঙ্গে দেখা করেছেন তার ছবি প্রচার করে। পত্রিকায় দেখলাম বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর এই ১০ মাসে প্রায় ৭০ দিন, অর্থাৎ দুই মাস পাঁচ দিন বিদেশে কাটিয়েছেন। এদের পেছনে এই বিরাট অংকের টাকা খরচ করে জাতি কি পেল সেটা এখনো আমরা জানিনা। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল সূট-টাইওয়ালা এই ভিখারিরা কখনোই নিজের পয়সায় পাঁচতারা হোটেলে থাকেন না; বা বিজনেস ক্লাস ট্রাভেল করেন না।

আমার বিশ্বাস এর জবাব ইউনূস সাহেবকে একদিন অবশ্যই দিতে হবে। আর এ কারণেই শিরোনামে প্রশ্ন রেখেছিলাম তার পরিণামও কি হবে নূরুল হুদার মত?

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন