কাশ্মীরের পহেলগামে হামলায় পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ভারত। কয়েকদিন আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির বলেছিলেন, বিশ্বের কোনও শক্তি কাশ্মীরকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করতে পারবে না। কাশ্মীরের বিষয়ে তার মন্তব্য ঘিরে ভারতে বিতর্কও দেখা যায়।
এরপর কাশ্মীরের পহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। মূলত পর্যটকদের লক্ষ্য করে চালানো মঙ্গলবারের এই হামলাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে।
প্রতিশোধ নিতে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে ঢুকে আবার ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালাক ভারতীয় সেনাবাহিনী, এই দাবিতে সরগরম সমাজমাধ্যমও।
কাশ্মীরসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-মিছিল হচ্ছে। সেখানে নানা স্লোগান দেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে পাকিস্তানে হামলার দাবি তুলেছেন বিক্ষোভকারীরা। যদিও ভারত সরকার এখনও পাকিস্তানের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, “কিছু সময়ের মধ্যেই যোগ্য জবাব।
রাজনাথ আরও জানিয়ে দেন, পাকিস্তানের হাতে সময় খুব কম। ভারত কাউকে ভয় পায় না, জঙ্গিদের কড়া জবাব দেওয়া হবে। যা জরুরি ও উপযুক্ত এই পরিস্থিতিতে, ভারত সরকার সেই সব কাজ করবে। ফল বোঝা যাবে খুব শিগগিরই।
বুধবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী বাস ভবনে জরুরি বৈঠকে বসেছেন নরেন্দ্র মোদী। সেখানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত আছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোবাল, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটি নিয়ে আলোচনা চলছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শশাঙ্ক যোশী বলেছেন, , “আমি বিশ্বাস করি ভারত আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে।” এই প্রসঙ্গে এক্স হ্যান্ডেলে পোস্টও করেছেন তিনি।
এর আগে ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে আত্মঘাতী হামলা চালায় জইশ-ই-মহম্মদের এক জঙ্গি। তাতে প্রাণ হারান ৪০ জন নিরাপত্তাকর্মী। ওই ঘটনার পর পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার বালাকোটে জইশ সন্ত্রাসীদের ক্যাম্পে বিমান হামলা চালায় ভারতীয় সেনারা।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানে হামলা?
ভারতে এই জাতীয় কোনও ঘটনা ঘটলেই পাকিস্তানকে নিশানা করা হয় বলে অভিযোগ তুলেছেন সে দেশের অনেকেই। পাকিস্তানি গণমাধ্যমেও একই কোথা প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানকার নিউজ চ্যানেল ‘সামা টিভি’র উপস্থাপক পহেলগালে হামলার সম্পর্কে বলেন, “ভারতে কোনওরকম সন্ত্রাসী হামলা হলেই সরাসরি পাকিস্তানের দিকে আঙুল তোলা হয়।”
পাকিস্তানি সাংবাদিক সিরিল আলমেইদা এক্স-এ উল্লেখ করেছেন, “ভারত যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে যারা এই কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া দরকার… তাহলে কেউ কি তাদের থামাতে পারবে?”
এই প্রসঙ্গে ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শশাঙ্ক যোশী বলেছেন, , “আমি বিশ্বাস করি ভারত আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে।” এই প্রসঙ্গে এক্স হ্যান্ডেলে পোস্টও করেছেন তিনি।
শশাঙ্ক যোশীকে একজন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই অনুমান সত্যি হলে তার সম্ভাব্য তারিখ কবে? জবাবে মি. যোশী লিখেছেন, “মে মাসের শেষ সপ্তাহে হওয়ার সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ। আর আমি এটা নিয়ে মজা করছি না।”
পুরোনো কথাই বলেছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী
ভারতে জঙ্গি হামলার একদিন পর বুধবার প্রতিক্রিয়া জানান পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ এদিন বলেন, “এই ঘটনায় আমাদের কিছু করার নেই।”
জঙ্গি হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনও যোগ নেই বোঝাতে গিয়ে আসিফ জোর গলায় বলতে চান, “আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপাবেন না। এর পিছনে আমাদের কোনও হাত নেই।”
পাক মন্ত্রীর দাবি, “আমাদের সত্যিই কিছু করার নেই, কোনও হাত নেই এই ঘটনায়। আমরা যে কোনও সন্ত্রাসবাদকে ঘৃণা করি, প্রত্যাখ্যান করি। শুধু এখানে নয়, পৃথিবীর যে কোনওখানে জঙ্গিপনাকে বরদাস্ত করে না পাকিস্তান।”
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছাড়াও পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রও বলেন, “অনন্তনাগ জেলায় পর্যটকদের উপর হামলার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন।”
পাক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আসিফ আরও বলেন, “ভারতে যা ঘটেছে তা ওদের দেশেই লালিত-পালিত। ভারতের অভ্যন্তরেই বিরোধিতার একটি অংশ।
তার কথায়, নাগাল্যান্ড থেকে কাশ্মীর, ছত্তীসগড়, মণিপুর এবং দক্ষিণের তথাকথিত রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহ দানা বাঁধছে। ফলে এই ঘটনা বিদেশি কোনও শক্তির কাজ নয়, একেবারেই ঘরের অশান্তিতে ঘটেছে বলে মতপ্রকাশ করেন পাক মন্ত্রী।
আসিফের কথায়, এইসব মানুষ এখন তাদের অধিকার চান। কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদী শক্তি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, মুসলিমদের অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে, তাই তারা প্রতিবাদ করছেন।
জঙ্গিরা নিরীহ-নিরস্ত্র পর্যটকদের নিশানা করায় আসিফ বলেন, “ভারত তো বালুচিস্তানে অশান্তি বাধাচ্ছে। আমরা একবার নয়, বারবার তার প্রমাণ দিয়েছি। পাকিস্তানে অস্থিরতা সৃষ্টির পিছনে রয়েছে ভারত। ভারত তার নাগরিকদের উপর যে ব্যবহার করছে, তাতেই সশস্ত্র প্রতিবাদ ঘনিয়ে উঠছে।”
“যদি সেনা আর পুলিশ মিলে যৌথভাবে দমন-পীড়ন চালায় তাহলে মৌলিক অধিকার রক্ষার দাবি তো উঠবেই। আর এসবের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করা ভারতের চিরাচরিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে,” বলেন মন্ত্রী।
পাকিস্তানের সেনা প্রধান হামলাকারীদের উস্কে দিয়েছেন?
ইসলামাবাদে এই প্রথমবার বার্ষিক ‘ওভারসিজ পাকিস্তান কনভেনশন’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৩ থেকে ১৬ এপ্রিল আয়োজন করা হয়েছিল ওই অনুষ্ঠান। সেখানে ভাষণ দেওয়ার সময় কাশ্মীরের প্রসঙ্গে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ টেনে এনেছিলেন জেনারেল মুনির। ভাষণে কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘জাগুলার ভেন’ হিসাবে আখ্যা দেওয়ার পাশাপাশি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্যও তুলে ধরেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “কাশ্মীরের বিষয়ে আমাদের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট এটা আমাদের জাগুলার ভেন ছিল এবং থাকবে। আমরা একে ভুলব না। আমরা আমাদের কাশ্মীরি ভাইদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে ত্যাগ করব না।”
উপস্থিতদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মকে এই বিষয়ে অবগত করতে হবে। তিনি বলেছিলেন, “আপনাদের সন্তানদের পাকিস্তানের কথা বলতে হবে যাতে তারা আমাদের পূর্বপুরুষদের চিন্তা-ভাবনাকে ভুলে না যায়- যে আমরা হিন্দুদের থেকে আলাদা।”
“আমাদের ধর্ম, রীতিনীতি, ঐতিহ্য, চিন্তা-ভাবনা, উদ্দেশ্য সবই আলাদা।”
জেনারেল মুনিরের বক্তব্যে বিভাজনমূলক বিষয় রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে এবং একে কেন্দ্র করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তার ভাষণের পরপরই পাকিস্তানের অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, তার বক্তব্যের জেরে পাকিস্তানে হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা বাড়তে পারে। হিন্দুরা পাকিস্তানের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
বর্তমানে প্যারিসের বাসিন্দা তাহা সিদ্দিকী একজন নির্বাসিত পাকিস্তানি সাংবাদিক।
জেনারেল মুনিরের এক ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করে তিনি লিখেছেন, “পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে গিয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের পক্ষে কথা বলেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এই তত্ত্বের পতন হয়। জেনারেল মুনির পাকিস্তানি শিশুদের মিথ্যা বলার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বা দিয়েছেন। স্পষ্টতই, এটা যুবকদের মগজ ধোলাই করারটাকে সহজ করে তোলে। এটা লজ্জাজনক।”
পাকিস্তানের সুফি পণ্ডিত ও সাংবাদিক সাবাহাত জাকারিয়া জেনারেল মুনিরের ভিডিও ক্লিপের বিষয়ে বলেন, “প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কারা? আমরা যদি হিন্দু ও মুসলমানদের কথা বলি, তাহলে ভারতে ২০ কোটি মুসলমান বাস করে। আপনি যদি আপনার চিন্তাধারা অনুযায়ী চলেন, তাহলে এই ২০ কোটি মুসলমানও বাকি ভারতীয়দের থেকে আলাদা।”
“পাকিস্তান কি তাদের ২৪ কোটি মুসলমানের মধ্যে ২০ কোটি ভারতীয় মুসলমানকে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রস্তুত? ভারতের মুসলিমরাও কি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে চায়? আর যে ১০ লাখ আফগান মুসলিমকে বিতাড়িত করা হচ্ছে, তাদের কী হবে? তারা কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানে বসবাস করছে। দ্বিজাতি তত্ত্ব কি তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়?”
হামলাকারীদের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক কী?
কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় তোলপাড় গোটা দেশ। এ হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ নামে স্বল্প পরিচিত এক জঙ্গিগোষ্ঠী।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দাবি করছে, হামলাকারী ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্সের’ সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক রয়েছে। ফলে নতুন করে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স নামের গোষ্ঠীটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা এক বার্তায় হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারা ভারতের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছে, ৮৫,০০০-এরও বেশি বহিরাগত এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে, যা জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।
বুধবার এক নতুন বিবৃতিতে গোষ্ঠীটি বলেছে, লক্ষ্যবস্তু করা ব্যক্তিরা সাধারণ পর্যটক ছিলেন না। বরং তারা ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সাথে যুক্ত এবং তাদের হয়ে কাজ করছিলেন।
গোষ্ঠীটি আরও বলেছে, আক্রান্তরা সাধারণ পর্যটন গোষ্ঠী ছিল না বরং তারা গোপন সংস্থার লোক ছিল। সেখানে পর্যটকের বেশে গবেষণার দায়িত্বে ছিলেন তারা। এই আক্রমণটি শুধু দিল্লির জন্যই নয় বরং দিল্লির সন্দেহজনক কৌশলগুলোকে সমর্থনকারীদের জন্যও একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে।
দুটি নিরাপত্তা সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, হামলার পরপরই শত শত নিরাপত্তা বাহিনী পহেলগাম এলাকায় ছুটে যায় এবং সেখানকার বনাঞ্চলে চিরুনি অভিযান শুরু করে।
ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বলেছে, কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামেও ভারতীয় সংস্থাগুলোর কাছে পরিচিত। তারা লস্কর-ই-তৈয়বা এবং হিজবুল মুজাহিদিনের মতো পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর একটি ফ্রন্ট।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, সন্ত্রাসীদের নিয়োগ, সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ এবং পাকিস্তান থেকে জম্মু ও কাশ্মীরে অস্ত্র ও মাদক পাচারের প্রচারণার জন্য বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইনের অধীনে টিআরএফকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করে।
এ সম্পর্কিত আরও খবর:
কাশ্মীরে ৩ সন্দেহভাজন হামলাকারীর স্কেচ প্রকাশ
উত্তেজনার মধ্যে পরমাণু অস্ত্রভান্ডার ঝালিয়ে নিচ্ছে ভারত-পাকিস্তান
জঙ্গি হামলার ন্যায়বিচার চাইলেন শাহরুখ-সালমান
কাশ্মীরে জঙ্গি হামলা: মোদীর জবাবদিহিতা চান ওয়াইসি
সন্ত্রাসী হামলায় রক্তাক্ত কাশ্মীর, ২৬ পর্যটকের প্রাণহানি