প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে নারী কোটা বাদ দেয়ায় লাভ কার?

বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬১ শতাংশই এখন নারী। তবে নতুন বিধিমালায় এই চিত্র বদলে যাবে।
বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬১ শতাংশই এখন নারী। তবে নতুন বিধিমালায় এই চিত্র বদলে যাবে।

‘কোটা না মেধা- মেধা মেধা’ এই স্লোগানের ধাক্কায় এক বছর আগে সরকারই গেছে পড়ে; তারপর বাংলাদেশ কি সামনে এগোচ্ছে, না পেছনে হাঁটছে; তা নিয়ে ধন্দে এখন অনেকেরই মনে।

অনেক প্রত্যাশার জুলাই অভ্যুত্থানের পর ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর চরম আস্ফালন দেখতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। নারীদের পোশাক নিয়ে হেনস্থা, মেয়েদের খেলতে বাধা, গানের অনুষ্ঠান বন্ধ, এমনতর নানা কিছু।

এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে যে নতুন বিধিমালা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, তাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের ঘরে ঢুকে যাওয়ার নতুন পথ তৈরি হল বলে আশঙ্কা করছেন নারী অধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, এর মধ্যদিয়ে লাভবান হবে সেই গোষ্ঠীই, যারা নারীদের সন্তান লালন-পালনকারীর বাইরে আর কিছু ভাবতে পারেন না।

গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রান্তিক অবস্থানে থাকা নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করার কৃতিত্ব যিনি বিশ্বজুড়ে তুলে ধরেন, সেই মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আমলে এমন নীতিমালার সমালোচনা উঠছে।

বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মোট সাড়ে ৬ লাখ শিক্ষকের মধ্যে ৪ লাখ ৩ হাজার জন বা ৬১ শতাংশই নারী। কোটা থাকায় প্রাথমিকে পুরুষ শিক্ষকদের তুলনায় দেড় লাখ বেশি নারী শিক্ষক।

শেখ হাসিনার শাসনামল নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও ওই সময়কালে বাংলাদেশের নারীদের অগ্রযাত্রা সারাবিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছিল।

মেয়েদের স্কুল গমনের হার বাড়াতে প্রাথমিকে নারী শিক্ষক বাড়ানোর লক্ষ্য ঠিক করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এক বছর আগে মেয়েদের স্কুল গমনের হার বেড়ে হয়েছিল ৯৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর উপবৃত্তিসহ নানা পদক্ষেপে স্কুল থেকে মেয়েদের ঝরে পড়ার হারও ১৩ শতাংশে নেমে এসেছিল।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় গিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ৬০ শতাংশ নারী নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আবার তার চালু করেন। তাতে ১৫ বছরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের সংখ্যা ৩ গুণ বাড়ে।

২০২৪ সালে অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে নারীদের জন্য পূর্বনির্ধারিত কোটা বাতিল করে নতুন নীতিমালা তৈরি করেছে।

তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠার পর বদলে যাওয়া আফগানিস্তানের নারীরা। ছবি: রয়টার্স ভায়া বিডিনিউজ।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২৮ আগস্ট ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’ নামে এ প্রজ্ঞাপন জারি করে।

নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরাসরি নিয়োগযোগ্য ৯৩ শতাংশ পদ মেধাভিত্তিক হবে। বাকি ৭ শতাংশ পদ কোটার জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

সেই কোটার মধ্যে থাকছে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ।

নতুন বিধিমালায় নারীদের জন্য কোনো কোটা নেই। ২০১৯ সালের বিধিমালায় নারীদের জন্য ৬০ শতাংশ কোটা, পুরুষদের জন্য ২০ শতাংশ এবং পোষ্য কোটায় ২০ শতাংশ পদ সংরক্ষিত ছিল।

নতুন বিধিমালা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নারী অধিকারে কাজ করে যাওয়া প্রতিষ্ঠান ‘উই ক্যান’ এর নির্বাহী সমন্বয়ক জিনাত আরা হক।

কীসের ভিত্তিতে নারী কোটা বাতিল হলো- সেই প্রশ্ন রেখে তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন, “কেন এই কোটা বাতিল হল? পোষ্য কোটা বাতিল সমর্থনযোগ্য, কিন্তু নারী কোটা বাতিল কেন, কোনো গবেষণা আছে?”
প্রাথমিকে নারী শিক্ষকের গুরুত্ব তুলে ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী জিনাত আরা বলেন, “আমরা যখন প্রত্যন্ত গ্রামে নারী নেতৃত্ব নির্মাণ বা তৈরিতে কাজ করতে চাই, ডোনাররা আমাদের টাকা দেন, নারীদেরকে ক্ষমতায়িত করতে হবে, তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই নারী শিক্ষকদেরকে আমরা পেয়েছি, কীভাবে তার এলাকাকে সে পরিবর্তন করেছে, নিজের জীবনে নির্যাতন বন্ধ করেছে, এমনকি ছোট ছোট মেয়েগুলো নারী শিক্ষককে রোল মডেল মনে করে।”

“একদিকে নির্যাতন বন্ধের আইন রিভিউ করছেন, অন্যদিকে নারীর অর্থনৈতিকভাবে সংযুক্তি সঙ্কুচিত করছেন। পুরাই পাকিস্তানি মডেল, দরিদ্র প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীরা ধুকে ধুকে মরবে, আর পয়সাওয়ালা ধনী নারীরা পোশাকে আশাকে প্রগতিশীলতার গল্প দেবে,” সরকারের সমালোচনা করেন তিনি।

নারী অধিকারকর্মী তাহিয়াতুল জান্নাত রেমি সরকারের এই সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন।

তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন, “এই সিদ্ধান্তটা শুধু একটা নীতিগত বদল না, বলা ভালো এটা প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের ‘রোল মডেল’ হবার স্বপ্ন হারানোর ঝুঁকি।

“আমরা মাঠে দেখেছি, একজন নারী প্রাথমিক শিক্ষক মানে একটি গ্রামে আরো ৫০টা পরিবারের মানসিকতার পরিবর্তন আনে। সে ওই অজপাড়াগাঁয় থেকে মাইলকে মাইল হেঁটে, নিজের জীবনে পরিবর্তন আনে, আবার গ্রামের অন্য মেয়েদেরও শেখায়, সাহস দেয়- ‘তুমিও পারো’।”

শুধু জনপ্রিয় দাবি পূরণ করতে গিয়ে নারী কোটা বাদ দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ‘নন্দিত সুরক্ষা’ নামে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা তাহিয়াতুল জান্নাত বলেছেন, “নারী কোটা কেন বাতিল করা হল, এই প্রশ্নের কোনো গবেষণাভিত্তিক উত্তর কি আছে?”

এই সিদ্ধান্ত সমাজে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলবে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি লিখেছেন, “নারী কোটা পুরো বাদ দিয়ে বাস্তব বৈষম্যকে ‘নিরপেক্ষতার’ নামে পুরো অদৃশ্য করার চেষ্টা মনে করি। মেধার সংজ্ঞা যদি শহুরে সুযোগ–সুবিধার দিকে ঝুঁকে থাকে, তখন নেত্রকোনা-রংপুর-ময়মনসিংহ-পটুয়াখালীর গ্রামীণ মেয়েটা শুরুতেই পিছিয়ে পড়বে। নীতিগতভাবে জেন্ডার–নিউট্রাল নিয়ম এই গলাসমান বৈষম্যের রাষ্ট্রে সামাজিকভাবে জেন্ডার–নিউট্রাল ফল দেয় না।

“এখন নারীর অবস্থা হলো স্পোর্টসে সবাইকে সমান দৌড়াতে বলে কারো কারো পায়ে ওজন বেঁধে রাখার মতো। এটা সমান সমান দৌড় না, ভ্রম বলা যায়। নারী কোটা বাদ দেওয়া ঠিক সেই ভ্রমকে নীতির মুখোশ পরানো।”

“এই উন্নয়নের ফটোফ্রেমে ‘প্রগতিশীল’ নারীর পোশাকের স্বাধীনতা আর নারী সলো ট্রাভেলারের গল্প থাকবে, কিন্তু গ্রামীণ নারীদের বাস্তব ছবিতে আলো আরো কমে যাবে,” বলেন তিনি।

কোটা না মেধা- এই স্লোগানের আলোকে বিধিমালা প্রণয়নের প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেছেন, “এই নীতির দরজা যতটা চকচকে দেখায়, ভিতরে ঢুকতে গিয়ে নারীরাই আগে ধাক্কা খাবে। মিলিয়ে নিয়েন।”

আরও পড়ুন