বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারে অভাব-অনটনের কারণে সিজিল নামে এক দালালের মাধ্যমে কোনো খরচ ছাড়াই সোনিয়া (ছদ্মনাম) সৌদি আরব যান। কার্যত তাঁকে বিদেশে পাচার করা হয়। সৌদি আরব ‘হাপার বাত’ নামে এক স্থানে এক বাসায় কাজ করতেন তিনি। সেই বাসার গৃহকর্ত্রী সোনিয়াকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার কারণে ছয় মাস কাজ করার পর পাসপোর্ট সঙ্গে করে পালিয়ে যান।
চার মাস অন্য বাসায় কাজ করার পর কোনো বেতন না পাওয়ার কারণে সেখান থেকেও সোনিয়া পালিয়ে যান এবং পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। তখন সোনিয়া শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তিন মাস থাকার পর বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় এবং তাঁকে একটি সেফ হোমে রাখা হয়।
সোনিয়া তাঁর পরিবারে ফিরে যেতে চান। লেখাপড়া শিখে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে চান। তবে তাঁর মামলাটি চালানোর ক্ষেত্রে কিছু ভিন্ন বাস্তবতা রয়েছে। তাঁর মা বয়স ১৫ বছরের পরিবর্তে ২৫ বছর দেখিয়ে সোনিয়ার জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরি করেছেন; যা আইনের পরিপন্থি ও দুর্নীতি। সোনিয়া টাকা দিয়ে দালালের মাধ্যমে বিএমইটির সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চাকরি নিয়ে গেলেও সেখানে গিয়ে প্রতারণা ও যৌন হয়রানির শিকার হন। বয়স কম হওয়ার কারণে তাঁর ওপর হয়রানি করা অভিযুক্তদের জন্য সহজ হয়েছে।
মাকে আসামি করা হলে সোনিয়া আরও অসহায় এবং বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। সে কারণে দেশে ফিরিয়ে আনার পর আইনগত পদক্ষেপ নিতে রাজি নন তিনি। তাই বিএনডব্লিউএলএ আইনগতভাবে মোকাবিলার জন্য এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বিভিন্ন কারণে পাচারের আসামিরা এভাবে পার পেয়ে যায়। ভিকটিমের সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় তারা নিজেরাও মামলা চালাতে আগ্রহী হন না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ ও যশোর মানব পাচারের হটস্পট হয়ে উঠেছে। এ তিন জেলার মতো অতিরিক্ত মানব পাচারের মামলা যেসব জেলায় রয়েছে, সেখানে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করতে হবে। এসব বিশেষ ট্রাইব্যুনালকে সঠিক অবকাঠামো, সরঞ্জাম ও ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। সেখানে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি এসব ট্রাইব্যুনালে ভুক্তভোগীদের মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো অবস্থায় এসব ট্রাইব্যুনালে ভুক্তভোগীদের হয়রানি বা সেবা প্রাপ্তিতে বাধা তৈরি করা যাবে না।
প্রতিবছর দেশ থেকে অনেক নারী পাচার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে কিশোরী-তরুণী এমনকি শিশুও রয়েছে। এসব পরিবার ও ভুক্তভোগীদের আইনগত সেবা দেয় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডিব্লিউএলএ)। দেশ থেকে নারী পাচারের সঙ্গে একটি রাঘববোয়াল চক্র জড়িত। তারা যশোর ও সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকায় বেশি তৎপর। এর বাইরে সারাদেশে মানব পাচার চক্রের পাঁচ শতাধিক সদস্য রয়েছে। নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে যশোর সীমান্তে। গত দুই বছরে পাচার হয়ে দেশে ফেরা অন্তত ৯০০ নারীকে আইনি সহায়তা দিয়েছে বিএনডিব্লিউএলএ। এর মধ্যে কিশোরী ও তরুণী বেশি।