অর্থ বছর শুরু হয় জুলাই মাসে, নতুন বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হয় এই মাসেই। মানুষও তখন নতুন বাজেটে শুল্ক-করের নতুন হার দেখে তার নিজের বাজেট কাট-ছাঁট শুরু করে।
বাংলাদেশে এবার জুলাই মাস গেছে আন্দোলনে, তাতে সরকার গেছে উল্টে, এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থনীতির এক সময়ে শিক্ষক মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন সেই সরকার অর্থ বছরের মাঝপথে এসে ভ্যাট বসাচ্ছে, কর বাড়াচ্ছে।
এমনটা বাংলাদেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। এবার পঞ্জিকা বছরের শুরুতে এসে অর্থ বছরের শুরুর মতো নতুন হিসাব কষতে হচ্ছে নাগরিকদের।
২০২৫ সাল শুরুর পর গত কয়েকদিনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে একের পর এক প্রজ্ঞাপন আসছে। তাতে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে, কর বাড়ানো হচ্ছে। দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষ যখন বিপাকে, তখন এই পদক্ষেপ তাদের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।
মূলত রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকার। সেই কারণেই যে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে, তা্র স্বীকারোক্তি গত ৪ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক প্রজ্ঞাপনেই রয়েছে।
সেখানে বলা হয়, ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক এবং আবগারি শুল্কের হার ও পরিমাণ যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে অর্থ বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে দুটি অধ্যাদেশ জারির খবর এসেছে প্রথম আলোতে। অধ্যাদেশ দুটি হলো- মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং দ্য এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫।
এই দুটি অধ্যাদেশ জারির পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ এসংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে। এর ফলে এই অধ্যাদেশের পরিবর্তনগুলো সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে গেছে।
মোবাইল ফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। ফলে মোবাইলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ বাড়বে। ভ্যাট বাড়ানোয় বাড়বে পোশাকের দাম, রেস্তোরাঁর খাবারের খরচও।
এছাড়া মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে মিষ্টি, ওষুধ, এলপি গ্যাস, ফলের রস, ড্রিংক, বিস্কুট, চশমার ফ্রেম, সিগারেটসহ নানা পণ্য।
এত দিন মোবাইল ফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের ওপর ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ছিল। তা ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ব্র্যান্ডের দোকান ও বিপণি বিতানের তৈরি পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। রেস্তোরাঁর ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
শুল্ক-কর বৃদ্ধির তালিকায় আরও আছে টিস্যু, সিগারেট, বাদাম, আম, কমলালেবু, আঙুর, আপেল ও নাশপাতি, ফলের রস, যেকোনো ধরনের তাজা ফল, রং, ডিটারজেন্ট, রং, মদ, পটেটো ফ্ল্যাকস, চশমার প্লাস্টিক ও মেটাল ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, সানগ্লাস, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও তাতে ব্যবহৃত তেল, বিদ্যুতের খুঁটি, সিআর কয়েল, জিআই তার ইত্যাদি। ভ্রমণ করও বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে মঙ্গলবার এনবিআর মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ও কম্প্রেসর শিল্পে আয়ের ওপর কর ২০ শতাংশে উন্নীত করার প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে। এতদিন যা ছিল ১০ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের বাজেট গত জুন মাসে সংসদে যখন পাস হয়েছিল, তখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। তবে অর্থ বছর শুরুর ৩৬ দিনের মধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তাদের বিদায় নিতে হয়।
তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তার প্রথম বাজেটে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরেছিলেন ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ পাঁচ মাসেই ৪২ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি। ফলে অর্থ বছরের বাকিটা সময় ঘাটতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেই নিয়ে শঙ্কিত অর্থনীতিবিদরা।
মূলত এই ঘাটতি মেটাতেই অর্থ বছরের মাঝপথে এসে বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, শুল্ক ও আয়কর বাড়াতে হচ্ছে সরকারকে। পাশাপাশি ঋণের শর্ত হিসাবে আইএমএফের চাপও রয়েছে।
ভ্যাট কর বৃদ্ধির চাপ সাধারণ মানুষের ওপর পড়াটা স্বাভাবিক। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমদ যদিও বলছেন, এটা মূল্যস্ফীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে না; কিন্তু তার সঙ্গে একমত নন অর্থনীতিবিদরা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, “এ ধরনের কর এমন এক সময়ে বাড়ানো হলো, যখন দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে শুধু নিম্ন আয় ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ নয়; মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছেন। এখন নতুন শুল্ক-কর আরোপের ফলে এই শ্রেণীর মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে।”
সেই ১৯৯১ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ভ্যাট প্রবর্তনের পর তা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের জন্য সোনার ডিম পাড়া হাঁসে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি সরকারই ভ্যাটের ওপর নির্ভর করে চলতে চাইছে।
গত অর্থ বছরে মোট রাজস্বের ৪০ দশমিক ৪৫ শতাংশই আদায় হয়েছিল ভ্যাট থেকে। চলতি অর্থ বছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে আদায়ের লক্ষ্য ধরা আছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট রাজস্বের ৩৮ শতাংশ।
ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করের উপর নির্ভরতা অর্থনীতির জন্য স্বাস্থ্যকর নয়, তা অর্থনীতির গবেষকরা বারবারই বলে আসছে।
লেখক-গবেষক কল্লোল মোস্তফা সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক কলামে লিখেছেন, “কর আহরণ বৃদ্ধির জন্য ভ্যাট বৃদ্ধি করাই একমাত্র পদ্ধতি নয়, ভ্যাট ও শুল্কের মতো পরোক্ষ করের বদলে প্রত্যক্ষ আয়কর বৃদ্ধি করাই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য।”
রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করের বদলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পরোক্ষ কর আদায়ের ওপর বেশি নির্ভর করা হলে তা ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়িয়ে দেয় বলেও সতর্ক করেন তিনি।
প্রত্যক্ষ কর আদায় করলে তা ধনীদের কাছ বেশি আদায় করতে হবে বলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারও সেই পথে হাঁটেনি বলে কল্লোল মোস্তফার মূল্যায়ন।
এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও একই রাস্তা ধরায় তিনি লিখেছেন, “তারা কর ফাঁকি রোধ ও বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধারে জোর দেওয়ার বদলে অগণতান্ত্রিক কায়দায় আইএমএফের কথা মেনে ভ্যাট বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা আদায়ের সহজ রাস্তা বেছে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান আইএমএফের প্রেসক্রিপশন মেনে পরোক্ষ কর বৃদ্ধির মতো বৈষম্য বৃদ্ধিকারী পদক্ষেপ গ্রহণ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্পিরিটের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।”
ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগের প্রতিবাদও এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি বৃহস্পতিবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে করে বাড়তি ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। নইলে সারাদেশে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে তারা।
সংবাদ সম্মেলনে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, রেস্তোরাঁয় ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ আগে থেকেই আছে। অর্থাৎ ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক মিলিয়ে ভোক্তাদের মোট ২৫ শতাংশ কর দিতে হবে। যা বর্তমান মূল্যস্ফীতির বাজারে ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় সম্ভবপর নয়। আর বিশ্বের কোথাও এত পরিমাণ ভ্যাট নেই।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ভ্যাটে আগের মতো ৫ শতাংশ করা না হলে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা প্রথমে মানববন্ধন করবেন। তাতে দাবি মানা না হলে সারাদেশে এক দিনের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখা হবে। এরপরও সরকারের সাড়া না মিললে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হবে।