মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতির পিতা নন, জয় বাংলা নয় জাতীয় স্লোগান। এবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার প্রধান চার সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। এদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। তাজউদ্দিন ছিলেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধ শেষে নতুন সরকার যাত্রা শুরুর পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। তাতে ১ হাজার ৩৬১ জনকে ‘লাল মুক্তিবার্তা স্মরণীয় যারা বরণীয় যারা’ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই তালিকায় অস্ত্র হাতে লড়াই করা সেনাবাহিনীর লোকজন ছাড়াও শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বের নাম ছিল। ছিল স্বাধীন দেশের সংবিধান রচনার উদ্দেশে গঠিত গণপরিষদ সদস্যদের নাম। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় নির্বাচিত সকল সদস্যই গণপরিষদের সদস্য ছিলেন।
ইউনূস সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা সৈনিকরা শুধু মুক্তিযোদ্ধা বলে স্বীকৃতি পাবেন। অন্যদের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
সেই মতো মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় পরিবর্তন করা হচ্ছে। এরফলে জীবিতদের অনেকেরই যেমন মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল হবে, তেমনই মরণোত্তর পরিচয় বদল হবে শেখ মুজিবসহ বহু নেতার।
এরইমধ্যে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধনের চূড়ান্ত খসড়ায় এ প্রস্তাব করা হয়েছে। জামুকার ৯৪তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১০ মার্চ এ-সংক্রান্ত কার্যপত্রে (খসড়াসহ অন্যান্য বিষয়) স্বাক্ষর করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম।
আইন সংশোধনের খসড়া অনুযায়ী, শুধু মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনীতিবিদই নন, আরও চার শ্রেণির স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় হবে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। এই চার শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধারা হলেন– প্রথমত, যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছেন এবং বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। দ্বিতীয়ত, যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূতসহ অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তৃতীয়ত, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক। এবং চতুর্থত, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
এই খসড়া কার্যকর হলে বিদ্যমান মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকার অন্তত ১০ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় বদলে যাবে। তাদের পরিচয় হবে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক সাংবাদিকদের বলেন, “রাজনীতিবিদরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে থাকবেন না। বীর মুক্তিযোদ্ধা কেবল তারাই থাকবেন, যারা রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। অন্য সবার পরিচয় হবে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। এখানে কারও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে না। সবার সুযোগ-সুবিধা একই থাকবে।”
উপদেষ্টা জানান, খসড়াটি চূড়ান্ত করে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। শিগগিরই উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
অধ্যাদেশটি অনুমোদন হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে যাবেন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী আর অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করায় জিয়াউর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বহাল থাকবে।
তবে ইউনূস সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা।
বিশিষ্টি শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, “আমরা ইতিহাসের সত্যটা জানি। কোনো আইন বদল করে কারও অবদান বদলে দেওয়া যাবে না। এটি করার প্রয়োজন নেই। এগুলো অপ্রয়োজনীয় কাজ, অপচয়মূলক কাজ।’”
তার ভাষ্য, যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত, তাদের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক না। কেউ যদি ভুয়া (অমুক্তিযোদ্ধা) হয়, তাকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
মানবাধিকার নেত্রী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল সমকালকে বলেন, “আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধ শুধু একটি কনভেনশনাল সামরিক যুদ্ধ ছিল না। একই সঙ্গে এর অন্যতম মূল অংশ ছিল রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক।”
“সেই সময়কার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অনুযায়ী সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ভুলত্রুটি সংশোধন অবশ্যই কাম্য। তবে ঢালাওভাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন এমএনএ বা এমপিএ, গণপরিষদ সদস্যসহ সবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় বাতিল করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে,” বলেন সুলতানা কামাল।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নানা মহল সচেষ্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রশ্ন তোলা সেটারই ধারাবাহিকতা। তাদের মনে রাখা উচিত, কয়েক দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। এটি ছিল পরিকল্পিত সংগ্রাম। রাজনীতিবিদরাই জনগণকে পথ দেখিয়েছেন। তাদের নেতৃত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে জনগণ অবহিত। তাই এ নিয়ে বিতর্ক করা সমীচীন নয়।”
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব বলেন, “আশা করব, বৃদ্ধ বয়সে মুক্তিযোদ্ধারা যেন আর নতুন করে হয়রানি না হন। মুক্তিযুদ্ধ জাতির ইতিহাসে মীমাংসিত সত্য। তাই এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টির অবকাশ নেই।”