নতুন দল নিয়ে ইউনূস বললেন এক, নাহিদ আরেক

অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূস।
অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূস।

‘ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়’- এই প্রবাদটি মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই বলেছিলেন ১৪ বছর আগে ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব নিয়ে তার সঙ্গে সরকারের রশি টানাটানি চলছিল।

সেদিন সংবাদ সম্মেলনে আসার পর সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন- রাজনীতিতে কি নামবেন? তার উত্তরে হাসতে হাসতে এই প্রবাদটি বলার পর তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন, “আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা খুব খারাপ।”

এই খারাপ অভিজ্ঞতাটি তার হয়েছে ২০০৭ সালে। জরুরি অবস্থা জারির পর অসাংবিধানিক সরকার নোবেলজয়ী ইউনূসকে দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা চালিয়েছিল। ইউনূসও নেমেছিলেন ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি দল গঠনে।

কিন্তু সেই ‘কিংস পার্টি’ গঠনের চেষ্টা হালে পানি পায়নি বলে পিঠটান দিয়েছিলেন ইউনূস; ব্যস্ত হয়ে পড়েন গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে। কিন্তু ২০১১ সালে তাকে সেই ব্যাংকছাড়া করে শেখ হাসিনার সরকার। আইনি লড়াই চালিয়েও হেরে যান তিনি।

এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তার রেশারেশি চলতেই থাকে। একের পর এক মামলায় জড়ানো হয় তাকে। গত বছরের জানুয়ারিতে শ্রম আইনের এক মামলায় তার সাজার রায়ও হয় আদালত থেকে।

তবে জেলে যেতে হয়নি তাকে; তার ছয় মাসের মধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনের। শেখ হাসিনা দেশছাড়া হওয়ার পর দেশে ফিরে আবার ‘বেলতলা’য় যান ইউনূস। অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের পছন্দে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

সরকারের কর্ণধার হলেও এবার আর নিজে রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে যাচ্ছেন না ইউনূস; চাইছেন, সঙ্গী ছাত্রনেতারা নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করুক। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ড সফরে ব্রিটিশি সংবাদপত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেও দিলেন, ছাত্ররা নতুন দল গঠন করবে, এজন্য দেশজুড়ে মানুষকে সংগঠিত করছে তারা।

বৃহস্পতিবার তার এই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর ভিন্ন প্রতিক্রিয়া এল জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের সম্মুখ সারির নেতা নাহিদ ইসলামের কাছ থেকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলনকালীন মুখপাত্র থেকে ইউনূসের এই সরকারের তথ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়া এই তরুণ বললেন, দল গঠনের কোনো সিদ্ধান্ত এখনও নেননি তারা।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের একটি পডকাস্টে ইউনূস বলেন, আগামী নির্বাচনে ছাত্ররা যেন একটি নতুন দল গঠন করে অংশ নেয়, সেজন্য তাদের উৎসাহিত করছেন তিনি।

নিজের উপদেষ্টা পরিষদে তিনজন ছাত্রনেতাকে নেওয়ার বিষয়টি তুেল ধরে তিনি বলেন, “আমি বলেছিলাম, যদি তারা দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারে, তাহলে তারা উপদেষ্টা পরিষদেও বসতে পারে। তারা ভালো কাজ করছে। এখন ছাত্ররা বলছে, কেন নিজস্ব দল গঠন করা হচ্ছে না, তারা একটা সুযোগ নেবে।”

এক্ষেত্রে তিনিও তাদের উৎসাহিত করার কথা জানিয়ে ইউনূস বলেন, “তারা বলছে, তাদের কোনো সুযোগ নেই, এমনকি সংসদে তাদের একটি আসনও থাকবে না। কেন? কারণ, কেউ তাদের চেনে না।

“আমি তাদের বললাম, পুরো জাতি তাদেরকে চেনে। তারা যা করতে চায়, সে বিষয়ে তাদেরকে একটা সুযোগ দিই। সুতরাং, তারা এটা করবে।”

অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণে তরুণদের রাজনৈতিক দল প্রয়োজন বলে মনে করেন ইউনূস। তিনি বলেন, “তরুণরা সত্যিই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছানোর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা নেই। তারা এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল গঠন করছে বা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এটা দরকার কারণ, রক্ত দিয়ে তারা যেগুলো অর্জন করেছে, সেগুলো তাদেরকে রক্ষা করতে হবে।”

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে নোবেলজয়ী ইউনূস এটাও বোঝেন যে দল গঠন করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়বে ছাত্ররা; তবে তাতে তারা উৎরে যাবে বলেও মনে করেন তিনি।

ইউনূস বলেন, “দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়ত তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এটাও একটা বিপদ। কারণ, রাজনীতি শুরু করলে সব ধরনের রাজনীতিবিদ তাদের সঙ্গে মিশে যাবে। তাই আমরা জানি না, তারা আমাদের দেশে যে রাজনীতি, তা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারবে কি না। তবে ছাত্ররা প্রস্তুত। তারা প্রচার চালাচ্ছে। তারা দেশজুড়ে লোকজনকে সংগঠিত করছে।”

ইউনূসের এই বক্তব্য সংবাদমাধ্যমের সূত্রে সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পেয়ে নাহিদ ইসলামের প্রতিক্রিয়া জানতে চায় সাংবাদিকরা। তখন তিনি বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠন বা কোনো দলে যোগ দেওয়ার জন্য সরকার থেকে উপদেষ্টাদের পদত্যাগের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত তারা নেননি।

ইউনূসের কথায় ছাত্রদের নতুন দলের খবরটি নজরে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক নেতাদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলাম যে নতুন রাজনৈতিক দল হোক বা অন্য কোনো দল হলেও আমরা সরকারে থাকা অবস্থায় সেটার সাথে সংশ্লিষ্ট হব না।

“কিন্তু এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয় নাই। আমি বা আসিফ (আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া) কেউই এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেই নাই।”

তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।

ছাত্রদের উদ্যোগে নতুন দল গঠনের তোড়জোড়ের খবরে সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ছাত্ররা উপদেষ্টাদের দায়িত্বে থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলে অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ=তা হারাবে, তাহলে নির্বাচনের সময় নতুন সরকারের প্রয়োজন পড়বে।

তার ওই কথায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানোর পাশাপাশি নাহিদ ও আসিফ জানিয়েছিলেন, তারা নতুন কোনো দলে যোগ দেওয়ার আগে উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দেবেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দল হবে না, এই ঘোষণা এই প্ল্যাটফর্মের নেতাদের রয়েছে। তবে জুলাই আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক কমিটি একটি রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে এগোচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নাহিদ, আসিফের মতোই সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা সারজিস আলম আবার এই নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠকের দায়িত্ব নিয়েছেন।

নাগরিক কমিটির এই দল গঠনের প্রক্রিয়াকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো। একে ‘কিংস পার্টি’ আখ্যায়িত করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, তা দেশের মানুষ ভালো চোখে নেবে না।

তার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া আসে নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর কাছ থেকে। “আমরা কোনো কিংস পার্টি গঠন করছি না,” বলেন তিনি।

আরও পড়ুন