ইউনূসের ‘নড়চড় বক্তব্যে’ কাটছে না নির্বাচনের ধোঁয়াশা

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর একটি প্রশ্ন বারবার উঠে এসেছে- নির্বাচন হবে কবে? বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে গত প্রায় পৌনে এক বছরে সুস্পষ্ট কোনো ‘রোডম্যাপ’ দিতে পারেননি, রেখে চলেছেন ‘একগুচ্ছ অস্পষ্টতা’। এ অবস্থায়, সময় গড়ানোর সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে সংশয়ও যেন বাড়ছে, যা বিএনপি নেতাদের বক্তব্যেও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত।

সর্বশেষ শনিবার ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এক বৈঠকে ডিসেম্বর থেকে জুন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার তাগিদের কথা পুনর্ব্যক্ত করার পর নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সন্দেহের তীর এখন দৃশ্যত ইউনূসের দিকে।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয়; ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি তাদের।

প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় ওই বৈঠকের পরপরই অবশ্য প্রেস উইং থেকে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছিল তাতে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের কথাই জানানো হয়েছিল। পরে এর সংশোধনী দেওয়া হয় ইউনূসের তরফে।

নির্বাচন অনুষ্ঠানর সময়সীমা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ‘নড়চড়’ বক্তব্য যে এবারই প্রথম এলো বিষয়টি তেমন নয়। গত আট মাসে মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য রেখে এসেছেন।

২০২৪ সালের ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, “কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়।”

১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।”

২০২৫ সালের ৩ মার্চ রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমিশনার আদজা লাবিবের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে মুহাম্মদ ইউনূস তাকে নির্বাচন নিয়ে নিজের সদিচ্ছার কথা তুলে ধরেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, “চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে।”

অবশ্য এর দিন সাতেক আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে যে হবে, সেই বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন এক অনুষ্ঠানে।

এর পর থেকে ধারণা করা হচ্ছিল মুহাম্মদ ইউনূস হয়তো সেপথেই হাঁটবেন। তবে শনিবারের বক্তব্যের পর একটি বিষয় স্পষ্ট, সরকার হয়তো তার ঘনিষ্ঠ অংশীজনের ‘অভিপ্রায়’ পূরণে নির্বাচনের দূরবর্তী সময়সীমা বেছে নিতে চাইছে!

কারণ মুহাম্মদ ইউনূস যাদেরকে তার ‘নিয়োগকর্তা’ হিসাবে বিভিন্ন সময় তুলে ধরেছেন, সেই ছাত্রদের গড়া নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি সংস্কারের আগে নির্বাচন আয়োজনের বিরোধিতা করে আসছে। একই সঙ্গে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে দলটির নেতাদের বলতে শোনা গেছে, যারা তড়িঘড়ি করে নির্বাচন চায় তারা মূলত বিগত সরকারের চিনিয়ে দেওয়া পথেই হাঁটতে চাচ্ছে।

জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচনের বিষয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে এগোনোর কথা বলে আসছে।

এ অবস্থায় বর্তমান সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ জাতীয় নাগরিক পার্টি আর এক সময়ের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে রীতিমত ‘নাস্তানাবুদ’ তিন মেয়াদে শাসনভার সামলানো বিএনপি।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দলটি এখন হামলা-মামলায় জেরবার ‘আওয়ামী লীগশূন্য’ মাঠ পেয়েও যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে! নির্বাচন নিয়ে বার বার তাদের আকঙ্ক্ষার কথা বলে এলেও মুহাম্মদ ইউনূসের কানে যেন তাদের বক্তব্য পৌঁছুচ্ছে না! দলের ভেতরেও বর্তমান সরকারের প্রতি বাড়ছে সন্দেহ-ক্ষোভ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, ১৬ এপ্রিল অন্তর্বর্তী প্রধানের সঙ্গে যে বৈঠকের কথা রয়েছে তাতে হয়তো সেসব ‘গোস্সার’ কথা খোলাখুলি তুলে ধরার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল বিএনপি।

এর মধ্যেই নির্বাচন প্রসঙ্গে বার্তা দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপিকে বাজিয়ে নিতে চাইছে কি না সেটিও দেখার বিষয়। তাছাড়া সম্প্রতি সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টাকে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে ‘জন আকাঙ্ক্ষার’ কথা তুলে ধরতে শোনা গেছে। সব মিলিয়ে ইউনূস ও তার সরকারের বিভিন্ন বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ ঘণীভূত হচ্ছে বলে বিভিন্ন মহলের অভিমত।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে তাগিদ প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন, তার সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়।

তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা আমাদের কাছে পূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তিনি সব কার্যক্রম চালাচ্ছেন। আমরা সেটা জাতির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর অনুরোধ করেছিলাম, যাতে জাতি আশ্বস্ত হয়, গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি যাতে কোনো ষড়যন্ত্রের সুযোগ না পায়। কিন্তু তিনি অন্য একটি ফোরামে গিয়ে নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে করার কথা বলেন। আমরা এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। উনি এখনো সে কথা বললে আমরা তার সঙ্গে একমত নই।”

বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যদি ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে থাকেন, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কোনো কর্মসূচি দেবেন কি না।

“আগামী ১৬ এপ্রিল আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বসব। আমরা জানতে চাইব, আসলে উনি কী চাইছেন,” যোগ করেন তিনি।

শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওই বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ ও সদস্য বদিউল আলম মজুমদার অংশ নিয়েছিলেন।

এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য গঠন) মনির হায়দারও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

আরও পড়ুন