নির্বাচন নিয়ে চাপের মুখে পদত্যাগের হুমকি ইউনূসের

ইউনূসের পদত্যাগের হুমকি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
ইউনূসের পদত্যাগের হুমকি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।

আগস্টে ছাত্রনেতৃত্বাধীন একটি আন্দোলনে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর লাখো বাংলাদেশি গণতন্ত্রের আসন্ন পুনরুজ্জীবন উদযাপন করেছিল।

অথচ প্রায় নয় মাস পার হয়ে গেলেও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সকলকে হতাশ করছে, যারা নতুন নেতা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। এখন সেই সরকারপ্রধান, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস হুমকি দিচ্ছেন যে, তাকে যদি ধীরে ধীরে নির্বাচন প্রস্তুতির কাজ করতে দেওয়া না হয়, তবে তিনি পদত্যাগ করবেন।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন অর্থনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারক হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূসকে দেখা হচ্ছিল বাংলাদেশকে সাময়িকভাবে স্থিতিশীল করার সর্বোত্তম সুযোগ হিসেবে, অন্তত যতক্ষণ না অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয়। সড়কে তখনো রক্তের দাগ শুকায়নি, সেই সময়েই তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু তার সহকারীরা বলছেন, দেশের সবচেয়ে বড় একটি রাজনৈতিক দল এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি জোট তাকে বাধা দিচ্ছে। এই জোট তার নীতির সমালোচনা করছে এবং বলছে, তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে খুব ধীরগতিতে কাজ করছেন।

বৃহস্পতিবার মুহাম্মদ ইউনূস হুমকি দেন যে, যদি তিনি অবাধভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন না পান, তবে তিনি পদত্যাগ করবেন।

সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার মতে, মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের একটি ভাষণ পর্যন্ত খসড়া করে ফেলেছিলেন। তবে অন্যান্য উপদেষ্টারা তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, তার পদত্যাগ বাংলাদেশকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। ওই কর্মকর্তা ফোনে জানান, সেনাবাহিনীর প্রধান সম্প্রতি যেভাবে এ বছরই নির্বাচন আয়োজনের দাবি তুলেছেন, তাতে ইউনূস বিশেষভাবে অসন্তুষ্ট। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ধারাবাহিক সমালোচনায়ও তিনি ভীষণভাবে ক্লান্ত বোধ করছেন।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার পুরনো বিরোধীদের নির্বাচনে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, আর নির্বাচন যত দ্রুত হয়, তাদের সামনে সুযোগ তত বেশি। অথচ তার দল এখন দমন-পীড়নের মধ্যে রয়েছে, এবং সম্প্রতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ হওয়ায় বাংলাদেশ কার্যত অর্থবহ কোনো রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি এবং তা ঠিক করার জন্য এলোমেলো ও অসংগত প্রচেষ্টাও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি ব্যক্তিগতভাবে দেশের সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছেন, নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক সমর্থন না থাকায় আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।

অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুবারক হাসান বলেন, “মি. ইউনূস একজন অসাধারণ ব্যাংকার হতে পারেন, তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দক্ষ নেতা হিসেবেও সফল হতে পারেন, কিন্তু যা তার মধ্যে অনুপস্থিত—এবং যা দিনে দিনে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে—তা হলো, তার মধ্যে দৃঢ় ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অভাব আছে।”

তার নিজের উপদেষ্টাদের দ্বারা মুহাম্মদ ইউনূস প্রায়ই অতিমাত্রায় প্রভাবিত হচ্ছেন বলেও মনে করেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ইউনূস মনে করছেন, যারা তাত্ত্বিকভাবে তাকে দেশের গণতন্ত্রকে পুনরায় সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করার কথা, তাদের মধ্যেই কিছু মানুষ তাকে উপেক্ষা করছেন।

সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত বুধবার যখন ঘোষণা দেন যে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া উচিত, তখনই মনে হয়েছে ইউনূস তার সহ্যের সীমায় পৌঁছে গেছেন।

এর আগেও মুহাম্মদ ইউনূস ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে দেশ হয়তো নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে, তবে তিনি এখনো কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি দেননি। তিনি তার মন্ত্রিসভাকে বলেছেন, তিনি মনে করেন না বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত।

গত নভেম্বরে জাতির উদ্দেশে ভাষণে ইউনুস বলেছিলেন, “নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এটি আর থামবে না। কিন্তু পথ চলতে আমাদের অনেক কাজ শেষ করতে হবে।”

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) জোর দিয়ে বলছে, দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আগে একটি গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট প্রয়োজন। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ দল নিষিদ্ধ হওয়ার পর, এই সাবেক বিরোধী দল এখন ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে চায়।

বিএনপি শুরুতে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে সমর্থন করলেও, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে একাধিক নীতিগত মতবিরোধের কারণে সহযোগিতা বন্ধ রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউনুস ও তার কর্মকর্তারা চান দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামকে বেসরকারীকরণ করতে; যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের অংশে একটি সাহায্য করিডোর খুলতে; এবং বাংলাদেশের প্রধান কর কর্তৃপক্ষকে বিভক্ত করতে।

৮৪ বছর বয়সী এই অর্থনীতিবিদের জন্য বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনা অত্যন্ত কঠিন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব একটি চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের একটি নিষিদ্ধ এবং অন্যটি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, এই অবস্থায় ইউনূস যেন আরও কিছু সময় কাটাতে চাইছেন।

এই বিলম্বনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন তার প্রতি সহানুভূতিশীল বিশ্লেষকরাও।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুবারক হাসান বলেন, “এই নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই হতে বাধা কোথায়? এটি পুরোপুরি সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে।”

শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করা ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা এরপর থেকে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে তারা ভয় পাচ্ছেন, বিএনপি যেন এই সুযোগে ক্ষমতায় চলে না আসে। বেশিরভাগ আন্দোলনকারী এখনও ইউনূসের ওপরই ভরসা রাখছেন।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউনূসের এক সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যার লক্ষ্য ছিল ছাত্রদের এ দলে আকৃষ্ট করা।

নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি ইউনূসকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ করেছেন। বৃহস্পতিবার তাদের মধ্যে কথা হয় এবং ইউনূস তাকে বলেছেন, তিনি যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখন তাকে যে প্রতিশ্রুতিগুলো দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো এখন ভঙ্গ করা হচ্ছে।

“বিভিন্ন গোষ্ঠী অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে এবং সরকারকে চাপে ফেলছে—এই পরিস্থিতিতে তিনি মনে করছেন, আর কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়,” বলেন নাহিদ ইসলাম।

নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads