ইউনূস চিঠি পাঠাবেন ট্রাম্পকে, কাজ কি হবে?

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছেন চিঠির খবর; তবে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত আশু পরিবর্তন আশা করছেন না বাণিজ্যমন্ত্রী।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছেন চিঠির খবর; তবে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত আশু পরিবর্তন আশা করছেন না বাণিজ্যমন্ত্রী।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক ঝড়ে উত্তাল তামাম দুনিয়া। বাংলাদেশও যায়নি বাদ; নতুন করে শুল্ক চড়েছে ৩৭ শতাংশ; আগের ১৫ শতাংশ মিলিয়ে ৫২ শতাংশে গিয়ে ঠেকছে। অর্থাৎ এখন বাংলাদেশের ১০০ ডলারের কোনো পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঢুকতে গেলে ৫২ ডলার শুল্ক গুণতে হবে।

বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান বাজার যখন যুক্তরাষ্ট্র, তখন সরকারকে নড়েচড়ে বসতেই হচ্ছে। একের পর এক বৈঠক করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।

তারপর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে দুটো চিঠি পাঠানো হবে, যার উদ্দেশ্য হবে ওই দেশটিতে তৈরি পোশাকের বাজার ধরে রাখা।

রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ে এক জরুরি সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা জানান বলে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে খবর এসেছে।

শফিকুলকে উদ্ধৃত করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে, ট্রাম্পকে চিঠি লিখবেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। আরেকটি চিঠি যাবে যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ বা ইউএসটিআরে, সেটি লিখবেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

“আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চিঠি দুটো যাবে,” বলেন তিনি।

এদিকে একই দিনে বাণিজ্য উপদেষ্টা আরেক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা আশু স্থগিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না।

রোববার সকালে ঢাকায় মার্কিন শার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে বৈঠক করে সচিবালয়ে ফিরে তিনি এমন কথা বলেন বলে প্রথম আলো জানিয়েছে।

বাংলাদেশে অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাবদলের তিন মাস পর অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে সে দেশেও ক্ষমতার পালাবদল ঘটে।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়া নোবেলজয়ী ইউনূসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতাদের, বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা সবারই জানা।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডেমক্রেট প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফেরেন ট্রাম্প। আর তাতে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা দেয়।

গত জানুয়ারিতে রিপাবলিকান ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর ইউনূসের তরফে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটদের মতো রিপাবলিকান পার্টিতেও তার বন্ধু রয়েছে।

সেই বন্ধুত্ব এখন কতটা কাজে দেবে, সেই পরীক্ষার মুখে এখন ইউনূস। বিশেষ করে ট্রাম্পের গত ২ এপ্রিলের ঘোষণার পর, যেদিন তিনি শতাধিক দেশের পণ্যে রেসিপ্রোকাল বা পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন। 

ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত অবশ্য নির্দিষ্ট করে কোনো দেশকে লক্ষ্য করে হয়নি; যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি তাদের পণ্যেই তিনি কর চড়িয়েছেন বেশি। বাংলাদেশও এর মধ্যে পড়ে গেছে।

কূটনৈতিক মহলের বিশ্বাস, ডেমোক্রেটরা হয়ত ট্রাম্পের মতো এত ক্ষ্যাপাটে আচরণ করত না, আর যদি করতই ইউনূস সেখানে নিজের নামের জোরে কিছু সুবিধা আদায় করে নিতে পারতেন। কিন্তু ট্রাম্পের বেলায় সেকথা খাটবে না।

তারপরও ট্রাম্পকে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইউনূস। বাড়তি শুল্ক হারের বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসন যাতে পুর্নর্বিবেচনা করে, সে বিষয়ে আলোচনা শুরু করার অনুরোধ রেখেই চিঠিটি যাবে বলে সরকারি সূত্রের বরাতে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে।

প্রেস সচিব শফিকুল সাংবাদিকদের বলেন, তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে নিয়ত যোগাযোগ রেখে চলছেন। ঢাকায় তাদের দূতাবাস ও ইউএসটিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে।

উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “তারা (যুক্তরাষ্ট্র) তো বলেছে যে এটা নেগোশিয়েবল (সমঝোতার যোগ্য)। বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। তো সেই জায়গা থেকেই আমরা (চিঠি) দিচ্ছি।”

সরকারের লক্ষ্য এখন কী- সেই প্রশ্নে সচিবালয়ের সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তাতে চীনসহ বড় বড় অর্থনৈতিক শক্তির দেশগুলোও পাল্টা পদক্ষেপ নিচ্ছে। পুরো বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের নাড়াচাড়া খাবে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা সবকিছুই মাথায় রাখছি।

“আপাতত আমরা প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি যাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রক্ষা পায়, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা যাতে আরও বাড়ানো যায়, সেটা আমরা করবো। আমার মনে হয় সেটা সম্ভব হবে।”

ট্রাম্পের মন জোগাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর দিকেই সরকার যাবে বলে প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান জানান। এলক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সেখানে ইউএসটিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছেন বলেও তিনি জানান।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই শুল্ক খড়গে বিশ্বের উন্নত দেশ, উদীয়মান অর্থনীতির দেশ, গরিব দেশ কেউই বাদ যায়নি। এর মধ্যে চীনের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ পাল্টা শুল্কের পথে গেলেও অনেক দেশ এরই মধ্যে ওয়াশিংটনে দেন-দরবার শুরু করেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনীতি বিষয়ক পরামর্শক কেভিন হ্যাসেট এবিসি নিউজকে বলেছেন, “এটা ঠিক যে অনেক দেশে বেশ ক্ষেপেছে, কড়া প্রতিক্রিয়াও দেখাচ্ছে; তার সঙ্গে এটাও ঠিক যে ৫০টির বেশি দেশ এরই মধ্যে সমঝোতার জন্য আলোচনায় বসতে চাইছে।”

বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির রোববার সকালে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জ্যাকবসনের সঙ্গে দেখা করতে যান একই উদ্দেশ্যে। তার সঙ্গে গিয়েছিলেন শিল্প উপদেষ্টা মো. আদিলুর রহমান খান, প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী।

বৈঠক কেমন হলো- সাংবাদিকরা জানতে চা্ইলে তিনি বলেন, “আমরা একটা ধারণা পেয়েছি যে আমাদের ধরনের অর্থনীতি যাদের আছে, পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে তারা কী অনুসরণ করছে এবং আমরা কী পদক্ষেপ নিতে পারি।”

কোনো আশ্বাস কি মিলেছে- সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “তারা তো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলবে না। আলোচনা হয়েছে, কিছু দিক-নির্দেশনা পেয়েছি। এর মধ্য থেকে আমরা কী প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হব, তা বোঝার চেষ্টা করেছি।”

সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ যেসব দেশের ওপর হয়েছে, তা গত শনিবার থেকেই কার্যকর করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোর ওপর আরোপিত শুল্ক কার্যকর হবে আগামী বুধবার থেকে।

তার আগে কোনো আশা না দেখার কথা জানিয়ে শেখ বশির বলেন, বুধবারের আগে কোনো দেশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্থগিতের কোনো আভাস তারা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করে পাননি।

“সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ধারণা ঘুরে বেড়াচ্ছে যে ৯ তারিখে কোনো কোনো দেশের জন্য স্থগিতাদেশ আসবে। এ ধরনের কোনো ধারণা (বৈঠক করে) পাওয়া যায়নি।”

আরও পড়ুন