মুসলিম পরিবারের শিশু ভূমিষ্ঠের পর তাকে আজান শোনানোর রীতি আজকের নয়। সাত দশকের বেশি সময় আগে ভারতীয় কিংবদন্তি তবলা বাদক ওস্তাদ আল্লা রাখা কুরেশির কোলে তার স্ত্রী যখন তাদের প্রথম সন্তানকে তুলে দিয়েছিলেন, সেই নবজাতককে আজান না শুনিয়ে, তবলার বোল শুনিয়ে পৃথিবীতে স্বাগত জানানো হয়েছিল।
সময়ের সাথে সাথে সেই শিশু কেবল বাবার নামই উজ্জ্বল করেননি, নিজেও হয়ে ওঠেন এক কিংবদন্তি; তিনি সদ্য প্রয়াত তবলাবাদক ওস্তাদ জাকির হোসেন।
একদিন আগে তার মৃত্যুর গুজবে শোকের অবগুণ্ঠন নেমে আসে চারপাশে, সেই গুজবই সত্যি করে জীবনের তাল-লয়-ছন্দের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে সোমবার ওস্তাদ জাকির হোসেন পাড়ি দিয়েছেন অনন্তলোকে।
সোমবার জাকির হোসেনের পরিবারের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এনডিটিভি।
জাকির হোসেনের বোন খুরশিদ আউলিয়া বলেন, “ভেন্টিলেশন মেশিন বন্ধ করার পর তিনি চলে যান। আমি বলবো জাকিরের মৃত্যু হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ফ্রান্সিসকোর একটি হাসপাতালের আইসিইউতে গত দুই সপ্তাহ ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন জাকির হোসেন। সেখান থেকে তিনি পৌঁছে যান জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, তাকে আর ফেরানো যায়নি।
জাকিরের মৃত্যুর পর তার আট বছর আগের একটি সাক্ষাৎকার নতুন করে তুলে ধরেছে এনডিটিভি। সেখানে এই সংগীত গুরু বলেছেন তার জন্মের পর বাবা আল্লা রাখা কীভাবে তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
জাকির বলেন, জন্মের পর তাকে নিয়ে তার মা যখন প্রথম বাড়িতে ঢুকে শিশুপুত্রকে প্রথমে আল্লা রাখার কোলে তুলে দেন।
“সন্তানের কানে বাবা প্রার্থনার বাণী পাঠ করে শোনাবেন, সেটাই রীতি ছিল। কিন্তু বাবা আমার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে আস্তে আস্তে তবলার বোল শুনিয়েছিলেন।
“এরপর বাবা বলেছিলেন, এটাই আমাদের প্রার্থনা, আমরা এভাবেই প্রার্থনা করি। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ছেলে হয়েও আল্লা রাখা বলেছিলেন, তিনি তার গুরুদের কাছে যা শিক্ষা পেয়েছেন সেটি তার ছেলেকে তিনি শেখাতে চান।”
আল্লা রাখার ওই কাজে তার মা দারুণ বিরক্ত হয়েছিলেন বলেও সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন জাকির।
জাকির হোসেনের জন্ম ১৯৫১ সালে মুম্বাইয়ে; তবলায় হাতেখড়ি মাত্র তিন বছর বয়সে। ১২ বছর বয়সেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পেশাদার বাদক হিসেবে পরিচিত পেতে শুরু করেন তিনি। তখন মঞ্চে তিনি বাজাতেন বাবার সঙ্গে।
তার আসল পদবি ছিল কুরেশি। ‘হোসেন’ তাকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল।
তার কাজের বেশিরভাগজুড়ে ছিল ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীত; পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সংগীতেও দখল ছিল তার। ভারতসহ অন্যান্য দেশের বহু চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন।
জাকির হোসেন এক সময়ে তবলায় যাদের সংগত করেছেন তারাও একেকজন কিংবদন্তি শিল্পী। পণ্ডিত রবিশঙ্করকে, যাকে জীবদ্দশায় দীর্ঘকাল সংগত করেছেন তার বাবা আল্লা রাখা। এছাড়া ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খান, পণ্ডিত শাস্ত প্রসাদ, বিসমিল্লাহ খান, পণ্ডিত কিষাণ মহারাজ, শিব কুমার শর্মা বা কত্থক নৃত্যশিল্পী বিরজু মহারাজকেও মঞ্চে সংগত করেছেন জাকির হোসেন।
তিনি পড়াশোনা করেছেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। অর্থনীতিতে এই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি।
আরেকটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, কলেজে পড়াশোনার সময় বাড়ি থেকে মুম্বাইয়ে তাকে যাওয়া আসা করতে হতো লোকাল ট্রেনে। ভিড়ে ভর্তি ওই ট্রেনে অনেক সময়েই বসার আসন জুটত না। বাধ্য হয়ে মেঝেতে খবর কাগজ বিছিয়ে বসতে হত।
“যদি তবলায় পা ঠেকে যায়, সেই ভয়ে তবলা কোলে নিয়ে বসতাম।”
প্রায় চার দশক আগে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ফ্রান্সিসকোতে পাড়ি জমান জাকির হোসেন। সেখানেও তিনি সংগীত নিয়েই ছিলেন। আন্তর্জাতিক সংগীতাঙ্গনে তার বিচরণ আরো বিস্তৃত হতে থাকে ওই সময় থেকে। যুগ যুগ ধরে তিনি বিভিন্ন দেশে অসংখ্য অনুষ্ঠান ও কনসার্টে শ্রোতাদের মাতিয়েছেন তবলার বোলে।
১৯৭৩ সালে জর্জ হ্যারিসনের লিভিং ইন দ্য ম্যাটেরিয়াল ওয়ার্ল্ড অ্যালবামে অংশগ্রহণ তাকে এনে দেয় এক বিরাট স্বীকৃতি। তার পর থেকেই বহু খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী যেমন জন ম্যাকলাফলিন, মিকি হার্ট, বিল ল্যাসওয়েল, ভ্যান মরিসন, জো হেন্ডারসনসহ আরও অনেকের সঙ্গে তবলা বাজিয়েছেন তিনি।
সংগীতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশ-বিদেশে বহু সম্মাননা পেয়েছেন জাকির হোসেন। ১৯৮৮ সালে ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবে ভূষিত করে। ২০০২ সালে পান ‘পদ্ম ভূষণ’, ২০২৩ সালে ‘পদ্ম বিভূষণ’ সম্মাননা।
জাকির হোসেন ১৯৯০ সালে পান ‘সংগীত নাটক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড’, যা সংগীত জগতে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা হিসেবে বিবেচিত। আর বিশ্ব সংগীতের সবচেয়ে মর্যাদাকর গ্রামি পুরস্কারও এই সংগীত মায়েস্ত্রো ঝুলিতে গেছে চারবার।