রাজনৈতিক এক সঙ্কটের মধ্যে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত হয়েছিল একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে ফখরুদ্দীন আহমদ থাকলেও ক্ষমতার নাটাই ছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের হাতে।
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ফখরুদ্দীন ও মইন দুজনই পাড়ি জমান বিদেশে। তারপর আর দেশে ফেরেননি তারা। বলা হয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে তাদের সেফ এক্সিটের এই ব্যবস্থা হয়েছিল।
তেমন আরেকটি রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে গত বছর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। আগেরটির মতো এই সরকারেরও সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন। ভোটের পর এক মুহূর্তের জন্য তার ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা নেই বলেও তার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের মতানৈক্য এবং পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়ার ইঙ্গিতের মধ্যে অনেকটা বোমাই ফাটালেন নাহিদ ইসলাম।
তিনি একটি টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ রেখেছেন এবং তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথাও ভাবছেন।
নাহিদের কথা এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ যে তিনি শুধু জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাই ছিলেন না, ইউনূস নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদেও ছিলেন। যাদের নিয়ে তিনি কথা বলেছেন, তাদের সঙ্গেই বসতেন তিনি।
নাহিদ এমনও বলেন, তারা যাদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন, তাদের দ্বারা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব প্রতারিত হয়েছে। ‘সময় হলে’ তাদের নাম প্রকাশ করা হবে।
নাহিদের মতো করে কথা বলেছেন সারজিস আলমও। অভ্যুত্থানকারীদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি) নাহিদ আহ্বায়ক, সারজিস রয়েছেন মুখ্য সংগঠকের পদে।
সারজিস নওগাঁয় সাংবাদিকদের বলেন, “কিছু উপদেষ্টার মাঝে আমরা এই আচরণ দেখতে পাচ্ছি যে যেন তারা এখন কোনোভাবে দায়সারা দায়িত্বটা পালন করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক্সিট নিতে পারলেই হলো।”
তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, “কোথায় সেফ এক্সিট নেবে? পৃথিবীতে সেফ এক্সিট নেওয়ার একটাই জায়গা, সেটা হচ্ছে মৃত্যু। এছাড়া কোনো সেফ এক্সিট নাই। আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান, সেখানে বাংলাদেশের মানুষ আপনাকে ধরবে।”
যদিও ফখরুদ্দীন ও মইন উ আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন এক যুগের বেশি সময় ধরে এবং সেখানে অনেক বাংলাদেশি রয়েছে। তবে তারা খুব একটা প্রকাশ্যে আসেন না সেখানেও।

সেফ এক্সিটের কথা কেন আসছে- সেই প্রশ্নে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, উপদেষ্টাদের নিয়ে নাহিদ-সারজিসের এমন বক্তব্য তাদের দলেরই বক্তব্য।
তার ভাষ্যে, “আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিচার ও সংস্কার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা। সেটি পালনের দায়িত্ব নিয়েও তা না করে কোনো কোনো উপদেষ্টা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচতে চান। নাহিদ কিংবা সারজিস সেই বিষয়টিই বলেছেন।”
এনসিপি নেতাদের বক্তব্য নিয়ে উপদেষ্টাদের কেউ, এমনকি তাদের আন্দোলনের সহকর্মী মাহফুজ আলমও মুখ খোলেননি।
বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকরা এনিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে। তিনি অনেকটা এড়িয়ে যাওয়ার ঢঙে বলেন, “নাহিদ ইসলামের বক্তব্যটা স্পেসিফিক হলে হয়তো সরকারের পক্ষ থেকে কথা বলা যেত। এখানে তো সরকারের বক্তব্য দেওয়ার তো সুযোগ নেই।”
তবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা অন্তত তার নেই।
তবে এই প্রসঙ্গে ইউনূসের একটি আচরণও নতুন করে সামনে আসছে। গত মে মাসে নাহিদই জানিয়েছিলেন, পদত্যাগের কথা ভাবছেন ইউনূস।
তখন তা নিয়ে শোরগোল তৈরি হয়েছিল। তবে ওই মাসের পরই অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে ইউনূস সরকারের টানাপড়েন তৈরি হয়। বিশেষ করে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে তার বৈঠকের পর থেকে।
এনসিপি নেতারা মনে করছেন, সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা বিএনপির সঙ্গে সখ্য তৈরি করেছেন। আবার কয়েকজন জামায়াতের সঙ্গে সখ্য রেখে চলছেন।
তার বাইরে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সঙ্গেও কেউ কেউ যোগাযোগ রাখছেন, এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। একদল কূটনীতিকের আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর বাসায় যাওয়ার পর থেকে সেই গুঞ্জনের সূত্রপাত।
অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে এখন ছন্নছাড়া অবস্থায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়ে আছেন। নেতারা কেউ বিদেশে পলাতক, কেউ কারাগারে। নিবন্ধন স্থগিত হওয়ায় ভোটে অংশ নেওয়ার সুযোগও আপাতত নেই।
এমনিতেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের মনে। তার মধ্যে উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিটের আলোচনা দেখে ভোটের আগে নতুন সঙ্কটের ইঙ্গিত পাওয়ার কথা বলছেন তারা।