করিডোর নিয়ে ‘সমঝোতা’ ইউনূস-তারেকের বৈঠকে?

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাবকে ঘিরে দেশজুড়ে বিতর্ক ও সমালোচনা এখনও থামেনি। এই ইস্যুতে বিএনপি স্পষ্টভাবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের পদত্যাগ দাবি করেছিল। করিডোরের মাধ্যমে দেশের ভৌগোলিক নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে তারা এমন দাবি তোলে আন্দোলনেরও ডাক দেয়।

তবে শুক্রবার লন্ডনে একটি নাটকীয় দৃশ্যপটের অবতারণা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেড় ঘণ্টাব্যাপী এক বৈঠকে মিলিত হন। আর আশ্চর্যের বিষয়, বৈঠকের আগে সেই বিতর্কিত খলিলুর রহমানই তারেক রহমানকে বরণ করে নেন এবং বৈঠক শেষেও সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন।

খলিলুর রহমানের মার্কিন নাগরিকত্ব থাকা ও না থাকা নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে দুই ধরনের ভাষ্যই এ পর্যন্ত মিলেছে। এসব আলোচনা-সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে এখনও তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে বহাল তবিয়তে কাজ করে যাচ্ছেন।

বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে তাকে করিডোর পরিকল্পনায় মূল ষড়যন্ত্রকারী বলে দাবি করে আসছে। যদিও তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে ইউনূস তাকেই সঙ্গে রাখেন এবং আলোচনার মূল ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন।

কেউ কেউ সন্দেহ করছেন, এটি ছিল ইউনূসের পূর্বপরিকল্পিত কৌশল, যা বিএনপিকে বিভ্রান্ত করে করিডোর ইস্যুতে নীরব সম্মতি আদায় করার প্রয়াস। এমনকি সংবাদ সম্মেলনেও খলিলুর রহমানকে উপস্থাপন করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়, বিএনপির আর বর্তমান প্রশাসনের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।

বৈঠকের সময় ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ লেখা পোস্টার নিয়ে ইউনূসের লন্ডন অফিসের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন বিএনপির নেতারা।

বৈঠকে খলিলুরের উপস্থিতি এবং তার সঙ্গে আলোচনার পর তারেক রহমানের অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে দলের ভেতরে ও বাইরে।

লন্ডনের পার্ক লেইনে ডরচেস্টার হোটেলে তারেক রহমান ও মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: পিআইডি

একদিন আগেই চ্যাথাম হাউজে এক আলোচনায় ইউনূস বাংলাদেশের ভোটারদের কটাক্ষ করে বলেছিলেন, সাধারণ মানুষ টাকার বিনিময়ে যাকে তাকে ভোট দিয়ে দেয়। যা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা চোখে পড়েছে।

অবশ্য শুক্রবারের বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন নিয়ে তার অবস্থান বদলিয়ে কার্যত রমজানের আগে নির্বাচন করতে তার সায় রয়েছে বলে তারেক রহমানকে আশ্বস্ত করেন। যদিও শর্ত জুড়ে দেন- সংস্কার ও বিচার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষদের কেউ কেউ একে ‘কৌশলগত ভেল্কি’ এবং ‘বিএনপিকে বিভ্রান্ত করার ফাঁদ’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন।

এরই মধ্যে রাষ্ট্রীয় খরচে মুহাম্মদ ইউনূসের চার দিনের যুক্তরাজ্য সফর নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

প্রায় চার দশকের বেশি দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা করা জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ তো ইউনূসের এই সফরকে ‘অন্তঃসারশূন্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করে লিখেছেন, এটা একটা কমপ্লিট ডিজাস্টার। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও প্রচার করা হচ্ছে সেখানে যেয়ে তিনি বিশ্ব জয় করে ফেলেছেন। আমি গত তিন চার দিন ব্রিটিশ গণমাধ্যমে এটা নিয়ে কোন খবর দেখিনি। অন্যান্য দেশেও একই ঘটনা ঘটেছে।

“দুঃখজনকভাবে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এই ডিজাস্টারের জন্য সিংহভাগ দায়ী ইউনূস নিজে এবং তার অনুগত প্রেস উইং। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে যে হাসিনা, মুনা নাইমুল ইসলাম খানদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে।”

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে বৈঠক বা ইউনূসের কথিত রাষ্ট্রীয় সফর নিয়ে তিনি লিখেছেন, “ইতিমধ্যে জেনেছেন এটা কোনভাবেই রাষ্ট্রীয়, সরকারি বা দ্বিপাক্ষিক সফর ছিল না। সেখানে পৌঁছানোর পর ইংল্যান্ডের কোন কর্মকর্তা তো দূরের কথা, কেউই ছিল না তাকে রিসিভ করার জন্য। তাকে রিসিভ করেছে বর্তমান হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম।”

লন্ডনে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের লাগাতার বিক্ষোভের মুখে অস্বস্তিতে থাকা মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য বাড়তি আক্ষেপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দেখা না পাওয়া। তবে নির্বাচনের সময় ঘিরে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির টানাপড়েনের মধ্যে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে এই বৈঠক সে অস্বস্তিকে খানিকটা আড়াল করতে পেরেছে বলে কারো কারো অভিমত।

লন্ডনে খলিলুর রহমানের সঙ্গে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর আলোচনার এই ছবি প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পাতায় দেওয়া হয়েছে।
লন্ডনে খলিলুর রহমানের সঙ্গে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর আলোচনার এই ছবি প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পাতায় দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, বিএনপির অনেক স্থানীয় ও জাতীয় নেতা এই বৈঠক নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। বিশেষকরে খলিলুর রহমানের উপস্থিতি তাদের বিব্রত করেছে বলেই ভাষ্য।

বিএনপির মধ্যম সারির একজন নেতা, যিনি তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত, বলেছেন, করিডোর ও জাতীয় নিরাপত্তার মতো ইস্যুতে বিএনপি যদি আর সরব না থাকে, তাহলে জনগণের কাছে দলের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

“যদি আমরা করিডোরসহ এইসব রাষ্ট্রবিরোধী ইস্যুতে অবস্থান পরিবর্তন করি, তাহলে জনগণ আমাদের বিশ্বাসঘাতক ভাববে।”

রাজশাহী অঞ্চল থেকে একাধিকবার বিএনপির হয়ে নির্বাচনে লড়া একজন সাবেক সংসদ সদস্য খলিলুর রহমানের উপস্থিতি নিয়ে তার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেছেন, “খলিলুর রহমানের উপস্থিতি ও সংবাদ সম্মেলনে তার অংশগ্রহণ আমাদের জন্য আত্মঘাতী। আমরা যে ব্যক্তি ও নীতির বিরুদ্ধে এতদিন প্রচার চালিয়েছি, আজ তাকেই বৈঠকের মুখ করে উপস্থাপন করা হলো।”

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন