বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর এমন ধুন্ধুমার সম্পর্ক কি আগে কখনো কেউ দেখেছে? উত্তর আসবে- ‘না’। সম্পর্কে মাঝে-মধ্যে খানিক চড়াই-উৎরাই দেখা গেছে, কিন্তু এক দলকে লক্ষ্য করে অন্য দলের নেতাদের আক্রমণাত্মক বক্তব্য, শ্লেষ-ব্যঙ্গ করা, এগুলো আগে কখনো দেখা যায়নি, যা দেখা যাচ্ছিল জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল, বিএনপি-জামায়াতের কোনো কথায় মিলছিল না। বিএনপি যখন দ্রুত নির্বাচন চাইছিল, তখন জামায়াত বলছিল, অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দেওয়ার কথা। বিএনপি সংস্কারকে কম গুরুত্ব দিচ্ছিল, জামায়াত দিচ্ছিল বেশি গুরুত্ব। মূল দুই দলের নেতারা বাক আক্রমণে সীমাবদ্ধ থাকলেও তাদের ছাত্র সংগঠন দুটি মারামারিতেও জড়িয়ে পড়ে।
পরিস্থিতি দেখে বিশ্লেষকরা যখন এভাবেই ভাবছিল যে দুই দলের পথ দুই দিকে বেঁকে গেছে; ঠিক তখনই সেই পথ আবার মিলে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। জামায়াত আমির লন্ডনে গিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করে আসার পরই এমন ইঙ্গিত মিলছে।
সম্প্রতি বেলজিয়াম হয়ে যুক্তরাজ্যে যান জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। সেখানে গত রোববার তিনি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। শফিকুরের সঙ্গে ছিলেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
চিকিৎসার জন্য গত জানুয়ারিতে লন্ডন গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। ছেলে তারেকের বাসায় এখন আছেন তিনি। জামায়াত নেতাদের সঙ্গে বৈঠককে বিএনপি নেতারা সৌজন্য সাক্ষাৎ হিসেবেই দেখাচ্ছেন। তারা বলছেন, অসুস্থ খালেদা জিয়াকে দেখতে এসেছিলেন জামায়াত আমির।

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন কথা শফিকুর বললেও তার দলের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বিবিসি বাংলাকে বলেন, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে আগামীতে দুই দলের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে।
তার কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় বুধবার ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দুই ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি নিকোল চুলিক ও এন্ড্রু হেরাপের সঙ্গে বৈঠকের পর জামায়াত আমিরের কথায়।
এতদিন ধরে নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে যথেষ্ট সময় দেওয়ার পক্ষপাতি হলেও এদিন তিনি বলেন, আগামী রমজানের আগেই অর্থাৎ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন চান তারা।
ঠিক এদিনই প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে তাদের দাবি আবারও জানিয়ে আসে। ইউনূস ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বললে তা নিয়ে অসন্তোষও প্রকাশ করে বিএনপি।
নির্বাচনে দেরি হলে দেশে যে নতুন সঙ্কট দেখা দেবে, সেই সতর্কবার্তাও সরকারকে দিচ্ছে দুই দলই।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন যদি না হয়, তাহলে দেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক পরিস্থিতি, সেটা আরও খারাপের দিকে যাবে। সেটা তখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।”
জামায়াত আমিরও অনেকটা একই সুরে বলেন, “জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে আবার বর্ষা আসবে, ঝড়-ঝাপ্টা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে, তখন ইলেকশনটা আবার অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে।”
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে আসলে শফিকুরের কী কথা হয়েছে, তা জানা যাচ্ছে না। তবে বিএনপিতে খালেদা জিয়া কিংবা তারেকের কথাই যে চূড়ান্ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ফলে তাদের সঙ্গে কথা হওয়ার পর নির্বাচন প্রশ্নে তাদের কাছাকাছি আসাটা ইঙ্গিতবহ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট হতে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে চাইছেন তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এটা তাদের মধ্যে মত পার্থক্য কমিয়ে আনার একটা চেষ্টা হতে পারে।
“দেখতে হবে কয়েকদিন পরে তারা পরস্পরের প্রতি বিষোদগার করছে কি না। যদি বিষোদগার কমে আসে, তাহলে বুঝতে হবে এই সাক্ষাৎ ও বৈঠক একটা ভূমিকা রেখেছে।”
কেন দূরত্ব, কেন নৈকট্য
জুলাই অভ্যুত্থানে তাদের মূল প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠ থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত দূরত্ব বাড়লেও মতাদর্শিক অবস্থানসহ নানা কারণে তাদের নৈকট্যই বেশি।
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী দল জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার পর।
জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হলেও স্বাধীনতাবিরোধী কয়েকজনকে তার মন্ত্রিসভায় স্থান দেন। তার মধ্যে অবশ্য জামায়াতের কেউ ছিল না। ১৯৭৮ সালে গঠিত বিএনপি জিয়ার মৃত্যুর পর যে ৭ দলীয় জোট গঠন করে, সেখানেও জামায়াত ছিল না।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক সূচনা ১৯৯১ সালে, সেবার সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয় জামায়াত। বিনিময়ে জামায়াত পায় সংসদের দুটি নারী আসন।
তবে সেই সম্পর্ক তখন বেশিদিন টেকেনি। আওয়ামী লীগ যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে, একই দাবিতে মাঠে নামে জামায়াতও। সংসদ থেকে তারা একযোগেই পদত্যাগ করে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর তারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম জোট বাঁধে। ১৯৯৯ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠন হলে তাতে জামায়াতও যোগ দেয়।
তাদের এই গাঁটছড়া আরো শক্তিশালী হয় ২০০১ সালের নির্বাচনে। জোট বেঁধে সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হওয়ার পর খালেদা জিয়া তার সরকারে মন্ত্রী করেন জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদকে।
এই দুই যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রী করায় সমালোচনা উঠলেও তা আমলেই নেয়নি বিএনপি। এই দুজনই পরে আওয়ামী লীগ আমলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের পর ফাঁসির দড়িতে ঝোলেন।
২০০৬ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতা ছাড়ার পরও তাদের জোট ঠিকই থাকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর জোটের পরিসর আরও বাড়িয়ে প্রথমে ১৮ দল ও পরে ২০ দল করলেও জামায়াত ঠিকই ছিল।

যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে বিএনপির ওপর জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার চাপ তৈরি হলেও তাতে সাড়া দেননি খালেদা জিয়া। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি একটি রাজনৈতিক কৌশল নেয়। ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট গড়ার পর সেই জোটে জামায়াতকে নেয়নি। আবার নিবন্ধনহারা জামায়াতের নেতাদের ঠিকই নিজেদের ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেয়।
২০২২ সালে আবার কৌশলী ভূমিকায় বিএনপি সব জোট ভেঙে দিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের কৌশল নেয়। তবে জামায়াতের সঙ্গে ওঠা-বসা আর নেই, এই কথাটি কখনো খোলাসা করে বলতেন না বিএনপি নেতারা। তারা শুধু বলতেন, যেহেতু তাদের কোনো জোট এখন আর নেই, ফলে জামায়াত তাদের জোটসঙ্গী নয়।
তবে গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শুধু যে চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে দুই দলের মতভেদ দেখা দিয়েছে, তা নয়; এই প্রথম বিএনপি অনেক নেতাকে একসঙ্গে একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকাকে সামনে আনতে দেখা যায়।
নানা অনুষ্ঠানে বক্তব্যের পাশাপাশি সোশাল মিডিয়ায় একে অন্যকে ঘায়েল করতে নানা ধরনের মিম, ব্যঙ্গচিত্রও প্রকাশ করতে থাকে। জামায়াতও কথা বলতে ছাড়েনি। পাশাপাশি তারা খালেদা জিয়ার বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৭ আসনে দলের প্রার্থীও ঘোষণা করে বসে।
এতদিনের মিত্র জামায়াতকে গত বছর থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে ভারতের একটি ভূমিকা থাকার কথা উঠে আসে বিবিসি বাংলার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে।
তাতে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে এখন আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতে বিএনপির প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে নয়া দিল্লির শর্ত ছিল জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ। আর বিএনপি সেই সুযোগ নিতে চাইছে বলেই জামায়াতের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়ছে।
পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জামায়াতকে নিয়ে ভারতের যে অস্বস্তি রয়েছে, তা বিবিসি বাংলাকে দেওয়া বিজেপি নেতা শমীম ভট্টাচার্যের বক্তব্যে স্পষ্ট।
তিনি বলেন, “আমরা স্পষ্টতই জামায়াতের যে চিন্তাভাবনা, তালেবানাইজেশনের যে কনসেপ্ট, তার ঘোরতর নিন্দা করি। এটার যে বিরোধিতা করে যাওয়া, সেটা আমরা করছি এবং করেও যাব।”
তবে জামায়াতের আমির শফিকুর বুধবার মার্কিন দুই কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে নিজেদের নিয়ে বলেছেন, তারা পুরোপুরি একটি ‘গণতান্ত্রিক’ শক্তি।
তারা জানতে চেয়েছিল, বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় জামায়াতের কী ভূমিকা, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে কী করবে?
জবাবে শফিকুর তাদের বলেছেন, “আমরা দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা করি, দেশ পরিচালনায়ও তা চাই।”
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে আসার পর জামায়াতের কথা বিএনপির কাছাকাছি যাওয়ায় এই প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে ভারত যেখানে ভাঙতে চায়, সেখানে কি ওয়াশিংটন বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য ধরে রাখতে চায়?
আওয়ামী লীগ আমলের শেষ দিকে শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে নানা অভিযোগের আঙুল তুললেও বিএনপি কখনো যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী দল নয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কখনো বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি জামায়াতকেও।