সেনা প্রধানের চড়া সুরের পর নির্বাচন প্রশ্নে এক কথায় এলেন ইউনূস

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান।

জার্মানির রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বললেন, এই বছরের শেষের দিকে নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছেন তারা।

সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসের বরাতে বুধবার এই খবর ছাপিয়েছে প্রথম আলো। শিরোনাম করেছে- ‘সরকার এ বছরের শেষের দিকে নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে: প্রধান উপদেষ্টা’।

প্রতিবেদনে ইউনূসকে উদ্ধৃত করে আরও বলা হয়, “আমরা জাতীয় নির্বাচনকে সফল করতে কঠোর পরিশ্রম করছি।”

নির্বাচন কবে হবে- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে দিলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের একটি বিষয় সব সময়ই থাকে। যেহেতু এখন সাংবিধানিক সরকার দেশে নেই, সেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও সিদ্ধান্তের বিষয় থাকে।

কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়ে ইউনূস নির্বাচন প্রশ্নে এই প্রথম একটি সময়ের কথা বললেন, যার অর্থ দাঁড়ায় এই বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

এর আগে কখনোই তিনি এই বিষয়ে একটি সময়ের কথা বলেননি, প্রতিবারই দুটি সময়ের কথা বলতেন। তার বক্তব্য ছিল, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। আর ব্যাপক সংস্কার হলে নির্বাচন হবে আগামী বছরের জুন নাগাদ।

সেই সঙ্গে এটাও বলতেন, অভ্যুত্থানের পর সংস্কার রয়েছে তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায়। ফলে নির্বাচন কবে হবে, তা নির্ভর করবে, জনগণ কতটা সংস্কার চায়, তার ওপর।

এমনকি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকেও ইউনূসের কাছ থেকে নির্বাচনের সঠিক দিনক্ষণ পাওয়া যায়নি। সেই বৈঠকেও বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছিল।

তার প্রায় দুই সপ্তাহ পর এখন প্রধান উপদেষ্টা দুটি সময়ের একটি বেছে নিতেই পারেন, তবে বিষয়টি ঘটল সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামানের এক ভাষণের পর।

মঙ্গলবারই জেনারেল ওয়াকার এক অনুষ্ঠানে ভাষণে বলেন, “আমি যতবারই ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি সর্ম্পূণভাবে আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন। দেয়ার শুড বি ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশন। এবং সেই ইলেকশন ডিসেম্বর অথবা এর কাছাকাছি সময়ে হবে। আমি আগেই বলেছি, ১৮ মাসের মধ্যে (নির্বাচন) করতে, আমার মনে হয় সরকার হয়তো সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছে।”

অভ্যুত্থানের পরের মাস সেপ্টেম্বরে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান বলেছিলেন, তখন থেকে দেড় বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।

তখন তার ওই বক্তব্য ভালোভাবে নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। বরং প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, নির্বাচন কবে হবে, সেই সিদ্ধান্ত কেবল ইউনূসই নেবেন, অন্য কেউ নয়।

তারপর বিভিন্ন সময় আগের মতোই দুটি সময়ের কথাই বলতেন ইউনূস। তবে এবার সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর আগের মতো কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি সরকারের তরফে।

বরং সাংবাদিকরা প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নৌপরিবহন ও শ্রম উপদেষ্টা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন বৃহস্পতিবার বলেন, “সেনাপ্রধান আমার জন্য অনেক উঁচু স্তরের লোক। তিনি একটি বাহিনী চালাচ্ছেন। তিনি কোনো কথা না বুঝে বলেননি। আমি যতটুকু চিনি, তিনি ভেরি স্ট্রেট ফরওয়ার্ড ম্যান। যা বলার মানুষের মুখের ওপর বলেন। সো আই হ্যাভ লট অব রেসপেক্ট ফর হিম।”

তার আগেই অবশ্য ইউনূস নির্বাচনের সময় নিয়ে ডিসেম্বরের কথা বলেন। সেনাপ্রধানের ভাষণের পরদিনই তার এই বক্তব্য আসা রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল উদ্দীপক।

মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা জেনারেল ওয়াকার এর আগে বিভিন্ন সময় কথা বললেও এতটা চড়া সুর আগে শোনা যায়নি। তার শরীরী ভাষাও ছিল অন্যরকম।

দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে তিনি যে সন্তুষ্ট নন, তা বুুঝিয়ে দিয়ে সেই ভাষণে বলেন – “আই হ্যাড এনাফ, লাস্ট সেভেন অর এইট মান্থ আই হ্যাড এনাফ।”

দেশে সব পক্ষকে মারামারি-কাটাকাটি বন্ধ করতে বলেন তিনি। প্রচ্ছন্ন হুমকির সুরে বলেন, “নিজেরা নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন, এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি আজ বলে দিলাম, নাহলে আপনারা বলবেন যে আমি আপনাদের সতর্ক করিনি। আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাদের।”

জেনারেল ওয়াকার ভাষণের মধ্যে এটাও বলেন, তার কথাগুলো সবার ভালো নাও লাগতে পারে। কিন্তু দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে তিনি এই কথাগুলো বলার প্রয়োজন মনে করছেন।

সেনাপ্রধানের মঙ্গলবারের ওই ভাষণে কর্তৃত্বের প্রকাশ অনেকেই টের পেয়েছেন। ভাষণে প্রধান উপদেষ্টাকে একাধিকবার শুধু ‘ড. ইউনূস’ সম্বোধনও অনেকের কানে লাগে।

সেনাপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে সরকারের তরফে কেউ কিছু না বললেও অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা থেকে উপদেষ্টা হওয়া আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফেইসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, “এই সরকারের ব্যর্থতা হলো কাউকে ম্যানেজ না করে চলা।

“আওয়ামী পূনর্বাসনের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আগ্রহী ডিপ স্টেট এবং উত্তরপাড়া, অথবা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের আধিপত্য কায়েমের আকাঙ্ক্ষা। কোনোটাকেই এই সরকার এখন অব্দি প্রশ্রয় দেয়নি। ফলে ভেতর-বাহির থেকে অসহযোগিতা তো আছেই।”

সেনাপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও চলছে আলোচনা। তবে এক বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন ছাড়া আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া কেউ জানায়নি।

চরমোনাই পীর নেতৃত্বাধীন দলটি এক বিবৃতিতে সেনাপ্রধানের বক্তব্য আমলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, “পেশাগত ও পদ্ধতিগত কারণে সেনাপ্রধান যা জানেন, তা রাজনৈতিক দলগুলো জানার কথা নয়।

“কিন্তু স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হলে সর্বদলীয় বৈঠক করে করণীয় নির্ধারণ করার রীতি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আছে। অতএব, সেনাপ্রধানের আশঙ্কা আমলে নিয়ে সেই আশঙ্কা দূর করতে অনতিবিলম্বে সর্বদলীয় বৈঠক করে করণীয় ঠিক করতে হবে।”

সেনাপ্রধানের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না, সে কারণে সেনাপ্রধানকে সবাইকে সতর্ক করে বক্তব্য দিতে হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি আরও বলেন, সেনাপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কিছু নেই। এই বক্তব্য তার ভালোই লেগেছে। কারণ দেশে এখন সবার ঐক্য প্রয়োজন।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বিবিসি বাংলাকে বলেন, রাজনীতিতে ঐক্যের জায়গায় বিভক্তির কারণে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, সেটাই সেনাপ্রধানের বক্তব্যে এসেছে।

তবে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের সার্বিক বিষয় নিয়ে তারা দলে আলোচনা করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবেন বলে জানান মতিউর।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে, ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা সবার সেদিকেই নজর দেওয়া উচিৎ।

আরও দলের কাছে বিবিসি বাংলা প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে উত্তর পায়, তারা নিজেদের ফোরামে আলোচনার পর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads