সেনাবাহিনী পড়েছে শাঁখের করাতে

গত বছর অভ্যুত্থানের ঠিক আগে ৩ আগস্ট সেনাসদরে অনুষ্ঠানে সেনা কর্মকর্তারা। ফাইল ছবি।
গত বছর অভ্যুত্থানের ঠিক আগে ৩ আগস্ট সেনাসদরে অনুষ্ঠানে সেনা কর্মকর্তারা। ফাইল ছবি।

গত এক বছর ধরে অনেকের মনেই কু ডাকছে, সেনাবাহিনীর ক্যু বুঝি হয়েই গেল। সেনাবাহিনী যে বাংলাদেশে ক্ষমতা দখল করেনি, এমনটা নয়। সেই ইতিহাসে চোখ রাখলে যে কেউ বলবেন, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্র গত এক বছরে বহুবার এসেছে। বরং এর চেয়েও কম সুযোগেও ক্ষমতা দখল হয়েছে।

তবে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত মুহূর্ত গত বছরের ৫ আগস্ট সবার সামনে এলেও ক্ষমতা দখলের কোনো অভিপ্রায় দেখাননি।

এরপর বিভিন্ন সময়ে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে সেনাবাহিনী রাজনীতিতে জড়াবে না এবং তার নিজেরও কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই।

সদিচ্ছা হোক কিংবা জাতিসংঘ মিশন হারানোর চাপে হোক, এরপর কোনো তৎপরতায়ই সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের কোনো ইঙ্গিত দেখা যায়নি। তবে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় সেনাবাহিনী মাঠে রয়েছে গত বছরের জুলাই থেকেই।

জুলাই আন্দোলন সহিংসতায় গড়ানোর পর আওয়ামী লীগ সরকার কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনীকে নামিয়েছিল মাঠে। কিন্তু আন্দোলন দমানো যায়নি।

গতবছরের আগস্ট মাস থেকে মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনী। ফাইল ছবি।

বরং সেই আন্দোলন প্রবল হয়ে রূপ নেওয় অভ্যুত্থানে। তাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন। তারপর গঠিত মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারও সেনাবািহনীকে মাঠেই রেখে দেয়।

ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে সেনাবাহিনী মাঠে থাকলেও ৫ আগস্ট থেকে কোনো ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে পারেনি, রক্ষা করতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটিও।

অভ্যুত্থানের আগে সেনাবাহিনী কেন পারেনি? সেই প্রশ্নের একটি উত্তর পাওয়া গেছে বেশ পরে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনার ভলকার টুর্কের কথায়।

অভ্যুত্থানের আট মাস পর তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে দমন-পীড়ন দেখে জাতিসংঘ সেনাবাহিনীকে এই বলে সতর্ক করেছিল যে এতে জড়িত হলে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

তা যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনীর পিছু হটার কথা।

সেনাবাহিনী পিছু হটেও ছিল, যা ৩ আগস্টের পর থেকে তাদের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছিল। পুলিশকে মোকাবেলা করতে থাকা অভ্যুত্থানকারীদের কাছে ৫ আগস্ট তো সেনাবাহিনী ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।

তবে এরপর সেনাবাহিনীর সঙ্গে অভ্যুত্থানকারীদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক থেকে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ গত মার্চে সরাসরি অভিযোগ তোলেন সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে।

হাসনাত দাবি করেন যে আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে তাদের চাপ দিচ্ছেন জেনারেল ওয়াকার; যদিও সেনাবাহিনী তা সরাসরি অস্বীকার করে।

এরমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গেও সেনাবাহিনীর দূরত্বে প্রেক্ষাপটে মাঠে থাকা সেনাসদস্যদের খুব একটা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

তবে মব আক্রমণ নিয়ে নতুন করে সমালোচনার মধ্যে হঠাৎ করেই সেনাবাহিনী তৎপর হয়ে উঠল। গত শুক্রবার জাতীয় পার্টির অফিস ভাংচুরে যাওয়া গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে বেধড়ক পেটায় সেনাসদস্যরা। তা নিয়ে সমালোচনার জবাবে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বলপ্রয়োগে তারা বাধ্য হয়েছিল

নুরের ওপর হামলার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি তোলে। তাদের ফেইসবুক পাতায় এক পোস্টে লেখা হয়- ‘ব্যারাকে যাও তাড়াতাড়ি/ নো মোর মিলিটারি’।

সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত পাঠানোর দাবি তোলার পরদিনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের পর বিপরীত কথা বলল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

তাদের এবারের পোস্টে লেখা হলো- ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়ার পরেও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের জিওসি কেন চবিতে পর্যাপ্ত ফোর্স পাঠালো না?’

যদিও সেনাবাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। এই বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের হাতে।

এক দিনের ব্যবধানে দুই রকম দাবি দেখে মাঠে থাকা সেনাসদস্যদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তারা কোন দিকে যাবেন?

আবার এর মধ্যে নতুন গুঞ্জনও ডালপালা মেলা শুরু করে রোববার সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির বৈঠকের খবরে।

বিভিন্ন সূত্র খবর দেয়, চীন থেকে ফেরা জেনারেল ওয়াকার দুপুরের আগে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের গুলশানের বাসায় যান, সেখানে তারা বেশ কিছুক্ষণ বৈঠক করেন।

সেই বৈঠকে কী হয়েছে, তা জানা যায়নি। তারমধ্যেই খবর আসে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছেন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তাদের আলোচনা কী নিয়ে হয়েছে, সেটাও জানা যায়নি।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান। ফাইল ছবি।

জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুলের দ্বন্দ্বের খবর অনেকেরই জানা। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অধীনে পরিচালিত সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের দায়িত্বে থাকা কামরুলের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের বেশ সুসম্পর্ক। বিতর্কিত খলিলকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করায় ওয়াকারের অসন্তুষ্টির খবরও বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছে।

রবিবার দুটি বৈঠকের পর জরুরি অবস্থা জারি এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লে দৃশ্যত তা চাপা দিতেই সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার একটি বৈঠক হয়।

এরপর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বেশ তৎপরতার সঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়, সেনাবাহিনী অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে।

ইউনূস ও ওয়াকারে বৈঠক ইদানিং খুব একটা না দেখা গেলেও সোমবার দুজনে মিলিত হন বলে খবর দেওয়া হয়।

অন্যদিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকেও একই কথা জানিয়ে কোনো ধরনের গুজবে কান না দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। তাতে বলা হয়, চীন সফর শেষে সেনাপ্রধান সৌজন্য সাক্ষাতে গিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে।

তাদের কথা সত্যি হলে বিষয়টি নিছকই গুজব ভাবা যায়। তবে গত বছরের আগস্টের শুরুতে সেনাবাহিনীর যে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য এসেছিল, তার সঙ্গে তাদের কাজে মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সহিংস আন্দোলন যখন চলছে, তখন গত বছরের ৩ আগস্ট সেনা সদরে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।

সেই অনুষ্ঠানে তিনি যে কোনো পরিস্থিতিতে জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব সেনা সদস্যদের নির্দেশ দেন বলে জানানো হয়।

 তখন জানমাল রক্ষায় সেনাবাহিনী নামিয়েছিল তৎকালীন সরকার। ফলে তার সেই নির্দেশনা সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়নেই, তা মনে হচ্ছিল।

কিন্তু পরে জানা যায়, ওই অনুষ্ঠানে সেনা কর্মকর্তারা ভিন্ন কথা বলেছিলেন। তারা সরকারের নির্দেশ মানতে আর রাজি ছিলেন না।

অথচ তার পরদিনও আইএসপিআরের বরাতে আসা বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ সরকার আরোপিত কারফিউ মেনে চলতে জনসাধারণকে আহ্বান জানিয়েছিল সেনাবাহিনী। তাতে বলা হয়েছিল, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনের আলোকে তার প্রতিশ্রুত দায়িত্ব পালন করে যাবে।”

অথচ তার পরদিন পাশার দান উল্টে গেলে সংবিধান মূল্যহীন হয়ে পড়ে, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায়ও সহযোগিতা করে যেতে হচ্ছে সেনাবাহিনীকে।

সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ জামান। ফাইল ফটো।

দৃশ্যত আওয়ামী লীগ সরকার যেমন বোঝাতে চেয়েছিল, সেনাবাহিনী তাদের পক্ষে রয়েছে; তেমনি ইউনূস সরকারও বোঝাতে চাইছে যে সেনাবাহিনী তাদের সঙ্গেই রয়েছে।

তাহলে সেনাপ্রধানের তৎপরতা কি গুজবের বাইরে কিছুই নয়?

এই গুঞ্জনের মধ্যেও সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে বড় রদবদলের খবর এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ নবম পদাতিক ডিভিশনে নতুন জিওসি এসেছে।

বগুড়ার এরিয়া কমান্ডার ও জিওসি মেজর জেনারেল আসাদুল হককে নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং সাভারের এরিয়া কমান্ডার হিসেবে বদলি করা হয়েছে।

কেন্দ্র সুরক্ষিত রাখতে সাভারের নবম পদাতিক ডিভিশন সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এই পরিবর্তন কিছুটা ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা কিছু রটে, তার কিছু তো বটেই।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন