চালের দামে উত্তাপ, আটায় ঝুঁকছে নিম্ন আয়ের মানুষ  

Rice vs Flour

ঢাকার মিরপুরের রাস্তায় ঘুরে চা বিক্রি করেন আব্দুর রব। স্ত্রী-সন্তানসহ পাঁচ জনের সংসার চালাতে রীতিমত গলদঘর্ম অবস্থা। ৫৩ বছর বয়সী এই ব্যক্তির ভাষ্য, জীবন আর চলে না!

তিনি জানান, গত শনিবার পাঁচ কেজি চাল কিনতে বাজারে গিয়েছিলেন; দাম দেখে তিন কেজিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাকে।

“আর দুই কেজি ময়দা কিনেছি। রাতে আমরা সবাই রুটি খাই এখন। চালের দাম বাড়লেও আমাদের আয় তো প্রতি সপ্তাহে বাড়ে না। বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিলাম।”

৪২ বছরের ফরিদা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে এক ছেলে দুই মেয়েকে মানুষ করছেন।

রাজধানীর খিলগাঁও বাজারের কাছে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। জীবনের সখ আহ্লাদ বলে কিছু নেই। শুধু তিন বেলার আহার জোগাড় করারই তার একমাত্র লক্ষ্য।

জানালেন, নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমাতে হচ্ছে খরচ।

“সপ্তাহে সপ্তাহে চালের দাম বাড়ায় হিমশিম খাচ্ছি। তাই বাধ্য হয়ে সকালে ও রাতে রুটি খাওয়া শুরু করেছি।”

খিলগাঁও বাজারে দাঁড়িয়ে যখন নিত্যদিনের দুঃসহ যন্ত্রণা আর অসহায়ত্বের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, চোখমুখে যেন তা ফুটে উঠছিল।

“এমনিতেই চালের দাম অনেক বেশি। তার মধ্যে আবার ওএমএস বন্ধ। আমাদের এখন না খেয়ে থাকার অবস্থা।”

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে এখন মোটা চালের কেজি ৫০–৫৫ টাকা। আর খোলা আটার দাম প্রতি কেজি ৪০–৪৫ টাকা; অর্থাৎ চালের চেয়ে গমের দাম কেজিতে ১০ টাকা কম।

গত এক মাসে বাজার ভেদে চিকন চালের দাম কেজিতে পাঁচ থেকে সাত এবং মোটা চালের দাম দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে।

মালিবাগ হাজীপাড়ার একটি মুদি দোকানে কথা হয় তৈরি পোশাককর্মী হাজেরা সঙ্গে। দোকানে এসেছেন চাল কিনতে। চালের দাম শুনেই দোকানির সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিলেন। পরে চাল না কিনে আটা নিয়েই বাসার দিকে রওনা হন।

কথা প্রসঙ্গে বললেন, “১২ হাজার টাকা বেতনে হাজীপাড়ার একটি গার্মেন্টসে কাজ করি। এই আয় দিয়েই চলে তিনজনের সংসার। চালের দাম বেশি হওয়ায় অনেক দিন ধরে টিসিবির চাল কিনে খাই। কিন্তু সেটিও বন্ধ। তাই বাধ্য হয়ে আটা কিনলাম। কী আর করা; পেটে কিছু না দিলে কাজ করবো কীভাবে?”

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএসের তথ্য বলছে, গ্রামীণ এলাকায় চাল কেনা বাবদ গড় মাসিক খরচ ২ হাজার ৮২২ টাকা। সিটি করপোরেশন এলাকায় চাল কেনায় খরচ ২ হাজার ২২১ টাকা এবং শহরাঞ্চলে ২ হাজার ৫৪০ টাকা। মাসিক খাদ্য ব্যয়ের সর্বোচ্চ ২২ দশমিক ৩৬ শতাংশ চাল কেনা বাবদ খরচ হয়।

ঢাকার বাদামতলী-বাবুবাজার চাল মার্কেট সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, “মোটা চাল কেজিতে দুই টাকার মতো বাড়ছে। খুব দাম বাড়েনি, তাও পাবলিক কম কিনে।”

ঢাকার লালবাগ এলাকার নবাবগঞ্জ বাজারের চাল ব্যবসায়ী মো. আব্দুল আলীম বলেন, “আড়ৎ থেকেই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। রশিদ দেখলেই বুঝতে পারবেন, তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।”

কৃষি বিপণন অধিদপ্ত ডিএএমের তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, আটাশের মতো মধ্যম মানের চাল পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি ৪৮ থেকে ৫৪ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৫২ থেকে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও খুচরা বাজারে মোটা চাল কেজিতে ৫২ থেকে ৫৮ টাকা, মাঝারি চাল ৬০ থেকে ৬৪ টাকা এবং সরু চাল ৭০ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে।

মোটা ও মাঝারি মানের চালের ক্রেতা মূলত স্বল্প আয়ের মানুষ। যার মূল্য কেজিতে বেড়েছে দুই থেকে চার টাকা পর্যন্ত। আর মধ্যবিত্তের তালিকায় থাকা মিনিকেট ও নাজিরশাইলের দাম ৭৫ টাকা থেকে ওপরের দিকে। একটু ভালো মানের মিনিকেট নিতে হলে অন্তত ৮০ টাকা গুণতে হচ্ছে।

চালের দাম বাড়ার লাগাম টানতে ব্যাপক আমদানির কথা বলেছেন খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আড়াই লাখ টন চাল আমদানি করা হবে। এছাড়া, মিয়ানমার থেকে জিটুজি বা সরকারি পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে এক লাখ টন চাল আমদানি চূড়ান্ত হয়েছে। পাকিস্তান থেকেও ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করতে আলোচনা চলছে।”

ভারত থেকেও জিটুজি’র মাধ্যমে চাল আমদানির আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি।

উপদেষ্টার চালের আমদানি আশ্বাসে বাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি। দ্রব্যমূল্যের কারণে আগে থেকে চাপে থাকা ক্রেতাদের খরচের পাল্লা বাড়িয়েছে চালের দাম বৃদ্ধি।

গেল ৬ মাসে চালের দাম গড়ে বেড়েছে ৩ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত। আর ২০২৩ সালের তুলনায় গমের দাম কমেছে গড়ে ২৪ শতাংশ। চালের বাড়তি খরচের লাগাম টানতে গরিব মানুষ ভাত কমিয়ে গমের খাবারের প্রতি ঝুঁকেছেন। এক বেলা ভাত ও দুই বেলা রুটি খাওয়া মানুষের সংখ্যা এখন অনেক বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, উঠে এসেছে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ গমের খাদ্যপণ্য বেশি খান। শহরে গমের খাবারের ব্যবহার বেড়েছে ২৬ শতাংশ। এর বিপরীতে চালের ভোগ ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ কমেছে।

দেশে গমের চাহিদার ১৪–১৫ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। আর চাহিদার বাকি ৮৫ শতাংশই আমদানি হয়। গমের উপর চাপ বাড়ায় এই পণ্য আমদানিও বেড়েছে। সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালে দেশে রেকর্ড পরিমাণ গম আমদানি হয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে প্রায় ৭২ লাখ ৭৫ হাজার টন গম আমদানি হয়েছে। ২০২৩ সালে আমদানি হয়েছিল ৫৪ লাখ ১৭ হাজার টন। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে গম আমদানি বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। আমদানি বৃদ্ধির এই হার গত আট বছরে সর্বোচ্চ।

জানতে চাইলে বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, চালের দাম যদি আটার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে গরিব মানুষ আটার রুটি খাওয়া বাড়িয়ে দেয়। চালের চেয়ে আটার দাম কম হওয়ায় গরিব মানুষের রুটি খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এ জন্যই গমের আমদানি বেড়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সাধারণত চাল ও আটার মধ্যে যেটার দাম কমে, সেদিকেই ভোগের প্রবণতা বাড়ে। কিন্তু বিশ্ববাজারে যেভাবে গমের দাম কমেছে, দেশে সেভাবে আটার দাম কমেনি। এ ছাড়া বাজারে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাও জরুরি।

অথচ পাঁচ বছর আগে গমের ব্যবহার কমেছিল এক-তৃতীয়াংশ। তখন উচ্চমূল্যের কারণে অনেকে রুটির পরিবর্তে ভাতের দিকে ঝুঁকেছিল। উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে দেশে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট গম ব্যবহার হয়েছিল ৫০ লাখ ৪৫ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৭৪ লাখ ৬৩ হাজার টন। অর্থাৎ চার বছরের ব্যবধানে খাদ্যপণ্যটির ব্যবহার কমেছিল ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ।

আরও পড়ুন