‘কোণঠাসা’ আ. লীগের গর্জন, কঠোর হবে সরকার?

ঢাকায় আওয়ামী লীগের এমন সমাবেশের দৃশ্য চোখে পড়েনি গেল সাত মাসে।
ঢাকায় আওয়ামী লীগের এমন সমাবেশের দৃশ্য চোখে পড়েনি গেল সাত মাসে।

মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি আওয়ামী লীগ। নেই প্রকাশ্যে দলটির শীর্ষ নেতারা। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটিকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়ার ঘোষণাও শোনা যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিন।

সেই আওয়ামী লীগ ছয় মাসের মাথায় আড়মোড়া ভেঙে হরতালসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি দিয়েছে, যা এখন রীতিমতো আলোচনায়। সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হয়েছে হুঁশিয়ারি।

কেউ কেউ কৌতুহল নিয়ে বলছেন, সরকার থেকে ছিটকে পড়ার পর যে দল নূর হোসেন দিবসে কর্মসূচি দিয়েও মাঠে নামতে পারেনি, তারা কি এবার পারবে? কারও কারও মনে প্রশ্নের উদ্রেক, আন্দোলনের জন্য ফেব্রুয়ারি মাসকেই বা কেন বেছে নিল তারা।

এর উত্তর মেলে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমানের উক্তিতে।

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ এখনও রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়নি। দলীয় কর্মসূচিতে অবশ্যই নেতাকর্মীরা মাঠে নামবে।”

আব্দুর রহমান আরও বলেন, “আওয়ামী লীগকে নিয়ে ইউনূস সরকার সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে, তাই আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়ার কথা বলছে। এটা বলার তারা কে? জনগণ ঠিক করবে আওয়ামী থাকবে কি থাকবে না।”

নিরপেক্ষ তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যে রায় জনগণ দেবে তা আওয়ামী লীগ মাথা পেতে নেবে বলেও মন্তব্য করেন আব্দুর রহমান।

দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল দ্য সান ২৪ কে বলেন, “প্রতিরোধ যতোই কঠিন হোক না কেন আমরা প্রস্তুত। জনগণের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দ্বিধা করেনি, করবে না।

“এ কর্মসূচি শুধু আওয়ামী লীগের কর্মসূচি নয়, এটি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। অবৈধ ও অসাংবিধানিক ক্ষমতা দখলকারী খুনি-ফ্যাসিস্ট ইউনূস সরকারের পদত্যাগ ছাড়া আমাদের নেতাকর্মীরা ঘরে ফিরবে না।”

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পোড়ানো হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।

রাজপথে ফয়সালার ঘোষণা দিয়ে কর্মসূচি দিলেও আওয়ামী লীগকে কঠোরভাবে দমন করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

তিনি বলেন, “ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ যত দিন না ক্ষমা চাচ্ছে, যত দিন না তাদের নেতৃত্বকে বিচারের মধ্যে আনা হচ্ছে এবং যত দিন না জবাবদিহির মধ্যে আসছে, তত দিন তাদের কোনো প্রোটেস্ট (প্রতিবাদ কর্মসূচি) করতে দেওয়া হবে না।”

অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের এই হুঁশিয়ারির সঙ্গে স্বৈরাচারী আচরণের মিল খুঁজে পাচ্ছেন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা কি চাইলে আইনের বাইরে কিছু করতে পারেন। আইনে যা নেই তা কি তিনি করতে পারেন? যে রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা না হয়, তাহলে সেই দলকে কোন আইনে বাধা দেবেন।”

সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার হাতে নির্বাহী ক্ষমতা আছে, সেটি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারে। তারপর অন্তবর্তী সরকার বলতে পারে, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলকে কোনো কর্মসূচি করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু সেটি তারা করছে না।”

অন্তবর্তী সরকার এখন যে আচরণ করছে সেটি স্বৈরাচারী বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ফেব্রুয়ারিতেই কেন কর্মসূচি?

আওয়ামী লীগ এমন সময় ‘কঠোর’ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন যে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠক হতে যাচ্ছে।

স্বভাবতই ওই বৈঠক বাংলাদেশের গণতন্ত্র ফেরানো নিয়ে কথা হবে। যার ইঙ্গিত ট্রাম্প-মোদীর ফোনালাপে প্রকাশ পেয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে হোয়াইট হাউসে আসবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।”

ফোনালাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে মোদী লিখেন, “আমরা এমন একটা ভরসাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর, যা দুই দেশের জন্য লাভজনক হবে। আমাদের দুই দেশের নাগরিকদের কল্যাণ, বিশ্বশান্তি, সমৃদ্ধি ও বিশ্বের সুরক্ষার জন্য একসঙ্গে কাজ করব।”

ট্রাম্পে-মোদীর ফোনালাপ নিয়ে হোয়াইটস হাউস একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, দুই দেশের সহযোগিতা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং ইস্যু ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

ভারতীয় সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনোজ দাস বলেন, “ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে, সেখানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ থাকবে না, তা তো হবে না। এরআগে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকেও বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেটি সাংবাদিকদের জানিয়েও ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অর্থীনীতির অবস্থা খুবই খারাপ। যুক্তরাষ্ট্র সমস্ত সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে শোচনীয় পরিস্থিতি বাংলাদেশে। তাই গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশকে ফেরানোর এটিই উপযুক্ত সময় ভাবছে আমেরিকা। এখন ইউনূস সরকারে চাপ দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র এবং সেটি এই ফেব্রুয়ারিতে।”

ভারতীয় সাংবাদিক ও দ্য ওয়াল এর এক্সিকিউটিভ এডিটর অমল সরকার দ্য সান ২৪ কে বলেন, “শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাতের পর, ভারতের সেভেন সিস্টার দখলসহ বাংলাদেশ থেকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান হয়েছে। ভারত সরকার সেসব বিষয় হালকাভাবে উড়িয়ে দেয়নি, ধৈয্য নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে।”

“বাংলাদেশে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ভারতের জন্যও হুমকি। তাই নরেন্দ্র মোদী ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠক অবধারিতভাবে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হবে। দুই দেশের সরকার প্রধান বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরাতে অবশ্যই উদ্যোগী হবেন।”

ফেব্রুয়ারি মাসে কোমর বেঁধে মাঠে নামার কৌশলগত আরও একটি কারণ হলো, সেসময় জাতিসংঘের একটি তদন্তকারী প্রতিনিধি দল ঢাকায় থাকবেন।

সেকারণে আওয়ামী লীগ ৫ আগস্ট পরবর্তী নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসকে মোক্ষম সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চায়।

আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দলও সেসময় জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করে অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের খতিয়ান তুলে ধরবেন।

একইসঙ্গে জাতিসংঘের ওই প্রতিনিধি দলকে কিছু এলাকায় সশরীরে যাওয়ার অনুরোধও করা হবে।

জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের সায় পেলে ঢাকার ধানমণ্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দলীয় অফিসে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুটি ভবনই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, করা হয় লুটপাট।

এরইমধ্যে ৫ আগস্ট থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিটি নৃশংসতার ঘটনার দিন-তারিখ ধরে ‘দ্য আগস্ট ফাইলস: আনটোল্ড স্টোরিজ’ নামে দীর্ঘ প্রতিবেদন তৈরি করেছে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উইং।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

হরতাল ও অবরোধ ডেকেছে আওয়ামী লীগ, আন্দোলনে ফেরার ঘোষণা

আরও পড়ুন