বিদায়ী বছরের ৬ অগাস্ট ছিল বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য একটি নতুন দিন। কারণ টানা কয়েক সপ্তাহ রক্তাক্ত বিক্ষোভে কয়েকশ মানুষের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আগের দিনই পতন ঘটেছিল শেখ হাসিনার শাসনের।
ছাত্রদের হাত ধরে আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল সরকারি চাকরিরর কোটা নিয়ে, পরে তা আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের বিক্ষোভে রূপ নেয়। ৫ অগাস্ট আন্দোলনের চূড়ান্ত দিনে ছাত্র-জনতা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে এগোতে থাকলে হেলকপ্টারে করে দেশ ছাড়েন হাসিনা।
হাসিনার দেশত্যাগে রাষ্ট্রক্ষমতায় যে শূন্যতা তৈরি হয়, তা পূরণও হয়ে যায় দ্রুত; এক সময়ের হাসিনার সমালোচক নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে দৃশ্যপটে হাজির হন।
বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও সহিংসতায় ক্ষতবিক্ষত একটি দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার- সবমিলিয়ে ৮৪ বছর বয়সী ক্ষুদ্রঋণের এই প্রবক্তার ঘাড়ে পড়ে পাহাড়সম দায়িত্ব।
গেল পাঁচ মাসে ঢাকার রাজপথে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য, স্কুল-কলেজগুলোও খুলেছে, হাসিনার বিদায়ের পর কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানো পুলিশ বাহিনীও অনেকটা থিতু হয়েছে, প্রাণ ফিরেছে রেমিটেন্ট প্রবাহে এবং সর্বোপরি জিডিপিও ৫ শতাংশে স্থির রয়েছে।
কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে ইউনূস সরকারের ব্যর্থতা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর ওপর হামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের কারণে এখনও স্বস্তিতে নেই বাংলাদেশ।
‘সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার শঙ্কায়’ গেল মাসেও যুক্তরাজ্য সরকার ভ্রমণ নির্দেশিকা সংশোধন করে নাগরিকদের একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাংলাদেশ ভ্রমণ এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির নাগরিকদের মধ্যেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
ভালো-মন্দ যাই হোক, হাসিনার বিদায় নেওয়া জরুরি ছিল বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রফিকুল ইসলাম। সরকার পতনের আন্দোলনে অনেকের সাথে রফিকুলও ছিলেন।
হাসিনার ১৫ বছরের বেশি সময়ের শাসনের চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ভাগ্য ফেরাতে বেশি সক্ষম হবে, এমনটাই বিশ্বাস করতে চান রফিকুল। তবে অর্থনীতি এবং প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তৈরি হওয়া উত্তেজনা ইউনূস সরকার যেভাবে মোকাবেলা করছে, তাতে তিনি হতাশ।
“আমরা জানি বাংলাদেশের অবস্থা রাতারাতি বদলাবে না, কিন্তু কোনো উন্নতিও দেখা যাচ্ছে না। আমাদের একটি নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন,” বলেন এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র।
ইউনূস সরকারের যে লম্বা সময় ধরে থাকার কোনো আইনি ভিত্তি নেই, সেটিও স্মরণ করিয়ে দেন রফিকুল। ২০১১ সালে হাসিনা সংবিথান সংশোধনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান বাতিল করেছিল।
রফিকুল বলেন, “এটি (অন্তর্বর্তী সরকার) নিয়মের ব্যত্যয়, যার পেছনে সেনা সমর্থন ও মানুষের বিশ্বাস রয়েছে এবং একবার প্রাথমিক আশাবাদ ফিকে হয়ে গেলে দেশে আবার বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।”
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতের প্রত্যক্ষদর্শী চট্টগ্রামের বাসিন্দা শেহনাজ খানের আশা শত শত আন্দোলনকারীর আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না।
ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হতে চাইলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং বিদ্যুতের ঘাটতি তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল চার সদস্যের পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তা হয়ে এসেছে।
প্রাথমিকের এই শিক্ষক বলেন, “যদি আমরা উন্নত জীবন না পাই, তাহলে আমরা চাইব পুরনো সময়ই ফিরে আসুক। আমি আমার পরিবারের জন্য তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতাম, কিন্তু চাল এবং অন্যান্য জিনিসের দাম বাড়ায় এখন দুই বেলা দিতে পারছি।”
গেল বছরের নভেম্বরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ১ দশমিক ২৩ বিলিয়ান ডলার কমে ১৮ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায় বলে তথ্য দিয়েছে কেন্দ্রীঅয় ব্যাংক। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি গিয়ে ঠেকেছে ১১ দশমিক শতাংশে।
অর্থনৈতিক সঙ্কট ছাড়াও সমালোচকরা বলছেন, ইউনূস নতুন নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো সময় দিতে ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, কাউকেই সুরক্ষা দিতে পারছেন না।
সরকার পরিবর্তনের পর থেকে সহিংসতার কারণে শত শত সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে।
ঘটনায় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ পাঁচ মাসে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার মাত্র ৮৮টি ঘটনার কথা জানালেও সংবাদ মাধ্যমে, বিশেষ করে ভারতে ব্যাপকভাবে কভারেজ পাচ্ছে এসব ঘটনা।
যদিও ইউনূসের দাবি, এসবই বহুদিন ধরে হাসিনাঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত প্রতিবেশী দেশটির ‘অতিরঞ্জিত প্রচারণা’।
ব্রিসবেনের গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়ান হল বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবশ্যই হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পরের সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারত। এমন সহিংসতাও আমরা দেখেছি, যা বিস্ময়কর ছিল।”
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো নতুন নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা জানাতে সরকারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান গত সেপ্টেম্বরে রয়টার্সকে বলেছিলেন, এক থেকে দেড় বছরের দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত।
আর ডিসেম্বরে ইউনূস ইঙ্গিত দিয়েছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের পরই জাতীয় নির্বাচন হবে। আর সেটি হতে পারে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে।
ভারতে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের এক জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর চার (৫ মাসের বেশি) হয়ে গেল, কিন্তু ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ইতিমধ্যেই ফাঁপা হয়ে গেছে।”
কটাক্ষ করে আওয়ামী লীগের সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, “তার (ইউনূস) মনে হয় ক্ষমতার ছাড়ার তাড়া নেই। তিনি মনে হয় উপভোগ করছেন। একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ইচ্ছা তার সবসময়ই ছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। তাই এখনই তার জ্বলে ওঠার সময়।”
ওদিকে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেই শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন বলে আগেই ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে এতদিন ধরে চলে আসা জাতীয় ছুটিগুলো বাতিল করে হাসিনার প্রতি জনরোষেরই যেন জবাব দিয়েছেন ইউনূস।
এর আগে শেখ মুজিবের ছবি সরিয়ে ফেলা হয় প্রেসিডেন্টের বাসভবন বঙ্গভবন থেকে, এছাড়া তার প্রতিকৃতি মুছে ফেলে চালু করা হচ্ছে নতুন নোট।
এমন অবস্থায় বাংলাদেশের অনেকেই মনে করছেন, অতীত মুছে ফেলতে খুব বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকার একজন কাপড় ব্যবসায়ী রাজু পোদ্দারের ভাষ্য, “এসব ভুল অগ্রাধিকার। কেউই নিষ্ঠুর অতীত মনে রাখতে চায় না কিন্তু সরকারের বর্তমান সময়কে শান্তিপূর্ণ করার দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। আন্দোলন-বিক্ষোভ, হামলা- এসব বন্ধ করা উচিত।”
সাধারণ মানুষের জীবন কতটা উন্নত হলো তার ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশে বিপ্লব ও ইউনূস সরকারের সাফল্য। কিন্তু জবাবদিহিতামূলক শাসন ব্যবস্থার দাবি এখনো রয়েছে দেশটিতে, যেখানে ১৫ বছর ধরে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিরোধী কণ্ঠকে দমন করা হয়েছে।
আরেকটি বিষয় হলো ভারত বিরোধিতা, যার মূলে রয়েছে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাওয়ার দাবি।
বিক্ষোভের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করতে হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে ইউনূস সরকার আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু ভারত অনুরোধ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও এর বেশি মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
অধ্যাপক ইয়ান হল বলেন, “ইউনুসকে নয়াদিল্লি ভালোই মেপেছে। নয়া দিল্লির প্রতিবেশীদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পক্ষ নেওয়ার প্রবণতা পুনর্মূল্যায়ন করার সময় এসেছে।”
সূত্র: দ্য ইনডিপেনডেন্ট