প্রক্সি ওয়ার নিয়ে বাংলাদেশে এখন কেন এত আলোচনা?

মিয়ানমারের রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।
মিয়ানমারের রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।

প্রক্সি ওয়ার বা ছায়া যুদ্ধ- শব্দটি অপরিচিত নয় বাংলাদেশে, তবে বিষয়টি খুব পরিচিত এমনটাও বলা যাবে না।

স্নায়ু যুদ্ধ অবসানের পর এতদিন মধ্যপ্রাচ্যে সঙ্কটের দৌলতে প্রক্সি ওয়ারের কথা শুনে আসছিল দেশবাসী, এখন নিজের দেশই এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরবরাহ পৌঁছাতে একটি মানবিক করিডোরের প্রস্তাব থেকে এই প্রক্সি ওয়ারের আলোচনার সূত্রপাত।

তা নিয়ে শুক্রবার এক আলোচনা সভায় প্রাবন্ধিক-কলামিস্ট ফরহাদ মজহার অভিযোগ তোলেন, মিয়ানমারে বাংলাদেশকে প্রক্সি ওয়ারে জড়াতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র।

তবে রবিবার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে এই আশঙ্কা ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান।

তিনি উড়িয়ে দিলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা থেকে থাকছে না; উদ্বেগ যে কাটছে, তাও বলা যাচ্ছে না।

প্রক্সি ওয়ার কী?

স্কুল-কলেজে প্রক্সি দেওয়ার বিষয়টির সঙ্গে সবাই পরিচিত। এক্ষেত্রেও ঘটনাটি তাই। নিজে সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে তৃতীয় পক্ষকে সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে উদ্দেশ্য হাসিলের প্রক্রিয়াটিই প্রক্সি ওয়ার।

সাধারণত বৃহৎ শক্তিগুলো নিজেরা যুদ্ধে না জড়িয়ে এমন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। বিশ্বের ইতিহাসে অতীত কালে ছায়া যুদ্ধের বহু নজির আছে।

গত শতকে স্নায়ু যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া একাধিকবার প্রক্সি ওয়ারে জড়িয়েছিল। যেমন অ্যাঙ্গোলায়, ভিয়েতনামে, আফগানিস্তানে।

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান লেবানিজ সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রক্সি ওয়ার চালায় বলে দাবি করা হয়ে থাকে।

ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে রাশিয়ার সঙ্গে প্রক্সি ওয়ার চালাচ্ছে বলেও অনেকের মত।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে, ইসলামী চরমপন্থি কয়েকটি দলের মাধ্যমে ইসলামাবাদ কাশ্মীরে প্রক্সি ওয়ার চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক পহেলগাম হামলাকে এর নজির হিসেবে দেখাচ্ছে নয়া দিল্লি।

প্রক্সি ওয়াররের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, এটি রাজনৈতিক বা সামরিক একনায়কত্বের উত্থানকে ত্বরান্বিত করে, সংঘাত বিস্তৃত হয়, সরবরাহ করা অস্ত্র ভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে পড়ার সুযোগ তৈরি হয়, আলোচনার পথ আটকে দেয় ইত্যাদি।

বাংলাদেশে কেন শঙ্কা?

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের দেশ মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ চলছে কয়েক বছর ধরে। সেই গৃহযুদ্ধের আঁচ বাংলাদেশেও এসে মাঝে-মধ্যে লাগছে গোলা-গুলি সীমান্ত পেরিয়ে উড়ে আসার মাধ্যমে।

মিয়ানমারে সঙ্কট বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগের কারণ। কারণ সেদেশের রাখাইন রাজ্যে নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়ে আছে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। গৃহযুদ্ধের মধ্যে সেই সংখ্যাটি দিন দিন বাড়ছে।

শরণার্থীদের ভার কমাতে বাংলাদেশ তাদের ফেরত পাঠাতে চাইছে। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তা নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে চুক্তিও হয়। কিন্তু রাখাইনে নিরাপদে বসবাসের সুযোগ রোহিঙ্গারা না দেখায় প্রত্যাবাসন আর শুরু হয়নি।

মানচিত্রে মিয়ানমারের রাখাইন ও চিন রাজ্য।

গত বছর অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পর দায়িত্ব নেওয়া মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারও এই সমস্যা সমাধানে তৎপর; তবে একটু ভিন্নভাবে।

আওয়ামী লীগ দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় গুরুত্ব দিলেও ইউনূস আন্তর্জাতিক উদ্যোগ চাইছেন। তার অংশ হিসাবে গত মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফরে আসেন।

এদিকে গৃহযুদ্ধে মিয়ানমারের অনেক রাজ্যে রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। যেমন বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ এখন বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।

এই পরিস্থিতিতে রাখাইনে যুদ্ধপীড়িত মানুষের মধ্যে ত্রাণ পাঠাতে বাংলাদেশের কক্সবাজার দিয়ে একটি মানবিক করিডোর বা চ্যানেল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন গুতেরেস।

সেই প্রস্তাব অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে বলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানানোর পর শুরু হয় পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল তাতে আপত্তি জানানোর পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এমন সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।

এরমধ্যে শুক্রবার বগুড়া প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় ফরহাদ মজহার রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার বিপক্ষে জোর আপত্তি জানান বলে জাতীয় সংবাদপত্রগুলোতে খবর আসে।

ফরহাদ মজহার বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে আরেকটি প্রক্সি ওয়ারে জড়াতে চায়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষের একজন মানুষ হিসেবে বলব, এই ধরনের করিডোর দেওয়া উচিৎ নয়।”

রাখাইনে করিডোর প্রতিষ্ঠা হলে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া হবে বলে মনে করেন অনেকে।

এখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কী? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আসে, মিয়ানমারকে চীনের প্রভাব থেকে বের করে নিজেদের কব্জায় আনতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

সেটা কীভাবে? মিয়ানমারে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট অং সান সু চিকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করা সামরিক জান্তার পেছনে চিনের সমর্থন রয়েছে। সেখানে বিদ্রোহী দলগুলো একটি সরকার গঠন করে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে লড়ছে, তাতে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো।  

খনিজ সমৃদ্ধ রাখাইন রাজ্য চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষিত রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের একটি অংশ। সেখানে গভীর সমুদ্রবন্দর, গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করছে চীন। বঙ্গোপসাগরে চীনের বের হওয়ার পথ মিয়ানমারই।

এখন যদি বিদ্রোহীদের হাতে জান্তা সরকারের পতন ঘটে, তাহলে চীনের বদলে মিয়ানমার তথা বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বেড়ে যাবে।

আর সেই পথ প্রশস্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে রাখাইনে আরাকান আর্মিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সহযোগিতা দিচ্ছে বলে সম্প্রতি ভারতীয় সাংবাদিক চন্দন নন্দী দাবি করেন।

তিনি নর্থ ইস্ট নিউজ নামে একটি অনলাইন পোর্টালে লেখেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিনটি ডিভিশন মিয়ানমারের দুটি বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মি ও চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। আর এটা ঘটছে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা মাফিক।

মিয়ানমারের বিদ্রোহী দলকে সহায়তা দিতে কক্সবাজারের টেকনাফের কাছে স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। এর উদ্দেশ্য বিদ্রোহীদের মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইকে বেগবান করতে যুক্তরাষ্ট্রের যে চাওয়া, তা পূরণ করা।

চন্দন দাবি করছেন, রাখাইন নিয়ে একটি সামরিক পরিকল্পনা দাঁড় করাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। আর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান রাখাইনে সরবরাহ পৌঁছে দিতে একটি করিডোর প্রতিষ্ঠা নিয়ে কাজ করছেন।

প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর ইউনূস জাতিসংঘে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা খলিলুরকে তার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ করেছিলেন। সম্প্রতি তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করেন।

সরকারের কী অবস্থান?

প্রক্সি ওয়ারে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা খলিলুর রহমান রোববার মিরপুর সেনানিবাসে বিইউপিতে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্যে উড়িয়ে দেন বলে প্রথম আলো জানায়।

রাখাইনে সংঘাত তীব্র হলে এমন ধোঁয়া উড়তে দেখা যায় বাংলাদেশ থেকেও।

তিনি বলেন, মানবিক করিডোরের নামে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ‘প্রক্সি ওয়ারে’ জড়াবে না বাংলাদেশ। এ নিয়ে যা প্রচার করা হচ্ছে, তা নিছকই অপতথ‍্য ও গুজব।

রাখাইনে ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে কোনো সমঝোতা এখনও না হলেও এনিয়ে বিতর্কের প্রসঙ্গ টেনে খলিলুর রহমান বলেন, এটা মানবিক করিডোর নয়। রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে একটি চ্যানেলের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আর চ্যানেল হলেও তা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে, তার মাধ্যমে ত্রাণ ও খাদ্য যাবে।

একই সভায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে জোর দিয়ে বলেন, দ্বিপাক্ষিক কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রাথমিক প্রচেষ্টা চালালেও তাতে কোনো বাস্তব ফল পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন