আল জাজিরা:
মুহাম্মদ ইউনূস, আল জাজিরায় আপনাকে স্বাগতম। আপনি শেখ হাসিনার পতনকে বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় মুক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আমি জানতে চাই, আপনি এই রূপান্তর পর্বটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
বাংলাদেশ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যেখানে দুর্নীতি ও সকল নীতিমালার লঙ্ঘন, প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস, দুর্নীতি ১০০ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। তখনই তরুণরা উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, ‘এবার যথেষ্ট হয়েছে, আপনাকে যেতে হবে।’ তারা রাস্তায় নেমে এই দাবি তোলে এবং ৫ আগস্ট এই পরিবর্তন ঘটায়।
তখন দেশজুড়ে যে বিশাল মাত্রার দুর্নীতি, নিষ্ঠুরতা ও অন্যায় চলছিল, তা নাগরিকদের প্রতি এক প্রকার নির্মমতা ছিল। অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ লুটপাট করা হয়েছিল, যা কিছু হাতের কাছে পেয়েছে, সবকিছু চুরি করা হয়েছিল।
তরুণদের আন্দোলনের মাধ্যমে সেই অধ্যায়ের ইতি টানা হয়। এক নতুন বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে – তারা একে ‘নতুন বাংলাদেশ’ বলছে।
পুরাতন বাংলাদেশ যেন এক ভয়ঙ্কর স্মৃতি, আমরা চাই একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে।
আল জাজিরা:
আপনি কতটা নিশ্চিত যে, পুরনো শাসনব্যবস্থা ফিরে আসবে না এবং সত্যিকারের পরিবর্তন ঘটবে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
এটা অবশ্যই সবার মনে এক ধরনের ভয়। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে। আমরা ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছি — সংবিধান, নির্বাচন, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদির জন্য।
তাদের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে আমরা ‘ঐক্যমত কমিশন’ গঠন করেছি, যারা সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ করে দেখবে কোন সুপারিশে কারা একমত, অসম্মত বা আংশিক একমত।
আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য সব দলের সম্মতিতে একটি ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করা, যেখানে সবাই সই করবে।
আল জাজিরা:
তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে জেন-জেড, মনসুন বিপ্লবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। তারা ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কীভাবে যুক্ত থাকছে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
তরুণরা কেবল আন্দোলনে অংশ নেয়নি, তারা এখন রাজনৈতিক দলও গঠন করেছে। এই নতুন রাজনৈতিক দলগুলোকেও অন্যান্য দলের মতো সুপারিশসমূহ নিয়ে মতামত দিতে বলা হচ্ছে — কোনটিতে তারা একমত, কোনটিতে নয়।
আমাদের উদ্দেশ্য, সর্বসম্মত মত গড়ে তুলে তা বাস্তবায়ন করা।
আল জাজিরা:
এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের পর আপনি কেমন ধরনের নেতৃত্ব দেখতে চান?
মুহাম্মদ ইউনূস:
আমি চাই না আমরা আবার ‘ফ্যাসিবাদী’ শাসনের কাছে ফিরে যাই। আমি চাই এমন নেতৃত্ব, যেখানে অর্থনৈতিক লুটপাট থাকবে না, মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না। যদিও কোনো নির্দিষ্ট নেতৃত্বের গ্যারান্টি দেওয়া যায় না, আমরা একটি শক্তিশালী, সংস্কার ব্যবস্থা তৈরি করতে পারি, যেখানে সবাই বাধ্য থাকবে নিয়ম মেনে চলতে।
আল জাজিরা:
আপনারা বলছেন পুরাতন দিনের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। আপনি কীভাবে এই প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত হবেন যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সত্যিই হবে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে: সংস্কার নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্যেই আমরা ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছি — সংবিধান, নির্বাচন, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদির উপর। প্রত্যেকটি কমিশন তাদের সুপারিশ জমা দিচ্ছে। আমাদের কাজ হচ্ছে: কোন সুপারিশগুলো জনগণের গ্রহণযোগ্যতা পাবে তা নির্ধারণ করা, আর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমত গড়ে তোলা।
আমরা একটি ‘ঐক্যমতের কমিশন’ গঠন করেছি, যারা সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যাবে। দলগুলো বলবে: কোন সুপারিশে তারা একমত, কোনটিতে নয়, আর কোনটিতে আংশিক একমত।
চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সুপারিশগুলোতে সবাই একমত, সেগুলো একত্রিত করে দলগুলোর সম্মতিসহ একটি ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করা। সব রাজনৈতিক দল এই সনদে সই করবে।
আল জাজিরা:
আপনার কাছে আদর্শ নেতা কেমন হওয়া উচিত, যিনি অন্তর্বর্তী সময়ের পর দেশ পরিচালনা করবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
আমি চাই না দেশ আবার ফ্যাসিবাদী শাসনে ফিরে যাক। আমি চাই না অর্থনীতিতে লুটপাট ফিরে আসুক। তবে কোনো ব্যক্তিবিশেষের গ্যারান্টি দেওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু আমরা যে প্রক্রিয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করছি, তা নিশ্চিত করবে যে যে কেউ আসুক, তাকে নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। আমরা ‘ব্যক্তি নির্ভর’ নয়, ‘প্রক্রিয়া নির্ভর’ রাষ্ট্র চাই।
আল জাজিরা:
আপনি ‘ফ্যাসিবাদী শাসন’ শব্দ ব্যবহার করেছেন — এটা তো খুবই শক্ত কথা। কেন আপনি এভাবে বললেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
কারণ গত শাসনামলে আমরা যা দেখেছি তা ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য বহন করে। ছাত্রদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা, মানুষের অধিকার হরণ, বিচার ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ — এসবই ফ্যাসিবাদের নমুনা।
আমাদের লক্ষ্য হলো, প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করা, নীতিমালা সংস্কার করা, এবং এমন মানদণ্ড স্থাপন করা, যেগুলোর ওপর সবার সম্মতি থাকবে।
মানুষ তখন বলতে পারবে: “তোমরা তো এই শর্তে সম্মতি দিয়েছিলে, তাহলে এখন সেটা অনুসরণ করছ না কেন?”
এই সম্মতির দলিলকেই আমরা বলবো ‘জুলাই সনদ’। এটি হবে আমাদের সকল পক্ষের জন্য একটি ঐতিহাসিক দলিল।
আল জাজিরা:
নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে আপনারা কী ভাবছেন? ডিসেম্বরের শুরুতে নাকি জুনের শেষ নাগাদ?
মুহাম্মদ ইউনূস:
এটা নির্ভর করছে আমরা কত দ্রুত ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারি তার ওপর। যদি দ্রুত অধিকাংশ বিষয়ে ঐকমত্য হয়, তাহলে ডিসেম্বরেই নির্বাচন হবে। যদি দীর্ঘ সময় নেয় এবং আরও অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। কিন্তু জুনের পরে আমরা আর নির্বাচন পিছাবো না।
আল জাজিরা:
আপনারা কীভাবে নিশ্চিত করবেন যে নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণযোগ্য হবে? আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কি অনুমতি দেওয়া হবে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি — বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন আমরা আয়োজন করবো। এটা আমাদের অঙ্গীকার।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আমরা অবশ্যই আমন্ত্রণ জানাবো, যেন নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়।
আল জাজিরা:
আওয়ামী লীগ — অর্থাৎ শেখ হাসিনার দল কি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
এটি মূলত দলের নিজেদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। তারা চাইলে অংশ নিতে পারে, না চাইলে নাও নিতে পারে। তারা এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেনি। সবকিছু নির্ভর করছে নির্বাচনী কমিশনের সিদ্ধান্ত ও নির্বাচনী আইনের ওপর।
আল জাজিরা:
আপনি কি মনে করেন, শেখ হাসিনার পতনের পর যে ‘হানিমুন’ (সমর্থনের) সময় ছিল, তা শেষ হয়ে এসেছে? এখন বড় বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
মানুষ এখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন করছে। কেউ বলছে না — “তাড়াতাড়ি নির্বাচন করে দিন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদায় নিক।”

সুতরাং, জনগণের ধৈর্য এখনো আছে। আমরা মনে করি, আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে শেষ করতে পারবো। রোহিঙ্গা সমস্যা অবশ্য আলাদা ইস্যু।
আমরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর, বিশেষ করে জাতিসংঘের সাথে কাজ করছি। আমাদের লক্ষ্য — নিরাপদ ও সম্মানজনকভাবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। তাদের নিজেদের ঘরে, নিজেদের জীবনে ফিরে যাওয়া উচিত।
আল জাজিরা:
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো সাহায্য কমানোর কথা বলছে। এতে কি আপনাদের উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ একা এই চাপ সামলাবে না। অনেক দেশ ও সংস্থা আমাদের সাহায্য করবে। তবে আসল লক্ষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো — যেখানে তারা নিজস্ব পেশা, জমি ও জীবন ফিরে পাবে। তারা শুধু কৃষক বা শ্রমিক নয় — চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীও আছে তাদের মধ্যে। তারা পুরো একটি সমাজ — যাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে হবে।
অতএব, এটা শুধু বাংলাদেশের দায় নয়, এটা গোটা বিশ্বের দায়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে তাদের আশ্রয় দিয়ে সর্বোচ্চ মানবিক কাজ করেছে।
আল জাজিরা:
আপনার সরকার শেখ হাসিনার আমলে গুম ও হত্যার জন্য ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আপনি কি জাতিসংঘ-নেতৃত্বাধীন তদন্তের আহ্বান করবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
ইতিমধ্যে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের নেতৃত্বে তদন্ত হয়েছে। তারা বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে সব নৃশংসতার বিস্তারিত আছে। আমরা খুশি যে, এটা আন্তর্জাতিকভাবে নথিভুক্ত হয়েছে। আমাদের নিজেদের তদন্ত এবং নথিপত্রও আছে।
আইনগত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এবং খুব শিগগিরই বিচার কার্যক্রম শুরু হবে — সম্ভবত এই মাসের শেষ বা আগামী মাসের শুরুতে।
আল জাজিরা:
এই বিচার প্রক্রিয়া কতদূর পর্যন্ত যাবে? সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও কি বিচারের আওতায় আসবে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
যে কেউ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, তাদের বিচার হবে। কাউকেই রেহাই দেওয়া হবে না — সেনাবাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থা যেই হোক না কেন।
আল জাজিরা:
আপনি বলেছেন, আগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আছে। নির্দিষ্ট কিছু উদাহরণ দিতে পারেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
অনেক উদাহরণ আছে এবং সবই জাতিসংঘের প্রতিবেদনে নথিভুক্ত হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রায় ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছিল। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে বন্দুকের মুখে নিয়ন্ত্রণ করে বিশাল ঋণ নেওয়া হয়েছিল — এমন ঋণ যা ফেরত দেওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কাগজে এগুলো ঋণ হিসেবে দেখানো হলেও, আসলে টাকাগুলো চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আল জাজিরা:
চুরি করা এই অর্থ কোথায় গেছে? এবং কীভাবে এই সম্পদ ফেরত আনার প্রচেষ্টা চলছে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
আমরা তদন্ত করে দেখেছি — অর্থের একটি অংশ ইউরোপে, কিছু ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে, আবার কিছু এশীয় দেশগুলোতে আছে। আমরা সেইসব টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছি, যতটা সম্ভব। বিদেশি সরকারগুলো আমাদের সাহায্য করছে। তারা বেশ সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখাচ্ছে।
আল জাজিরা:
বাংলাদেশ ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। তিনি শেখ হাসিনার ভাগ্নি এবং তার বিরুদ্ধে পারিবারিক দুর্নীতির মাধ্যমে লাভবান হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এটি কি সত্যিকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, নাকি রাজনৈতিক প্রতিশোধ?
মুহাম্মদ ইউনূস:
এটি নির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে দায়ের করা মামলা। দুর্নীতি দমন কমিশন এই অভিযোগ এনেছে। এরপর আদালত সিদ্ধান্ত নেবে — প্রমাণ যথেষ্ট কিনা।
আমরা সরাসরি তাকে জেলে পাঠাচ্ছি না। আইনি প্রক্রিয়া মেনেই এগোচ্ছে বিষয়টি।
আল জাজিরা:
টিউলিপ সিদ্দিককে কি যুক্তরাজ্য থেকে ফেরত আনা সম্ভব?
মুহাম্মদ ইউনূস:
আমরা চেষ্টা করবো। আমরা অবশ্যই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাবো।
আল জাজিরা:
আপনারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তিনি বর্তমানে ভারতে নির্বাসিত অবস্থায় আছেন। আপনারা কীভাবে তার অবস্থানকে দেখছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
সম্প্রতি ব্যাংককে বিমসটেক (দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সংস্থা) সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাথে আমার আলোচনা হয়েছে। আমি তাকে বলেছি — শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় আপনারা চাইলে দিতে পারেন, তবে তিনি যেন বাংলাদেশে গন্ডগোল পাকানোর জন্য বক্তব্য না দেন। কারণ, তার বক্তৃতায় আমাদের দেশে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
আল জাজিরা:
প্রধানমন্ত্রী মোদী কী জবাব দিয়েছিলেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
তিনি বলেছিলেন — ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উন্মুক্ত, সবাই কথা বলতে পারে। সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করে না।
আল জাজিরা:
আপনি কি মনে করেন, ভারত তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিচ্ছে এবং তাকে বিচার এড়াতে সাহায্য করছে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
এটা পুরোপুরি আইনি বিষয়। আমরা ইতিমধ্যে ভারত সরকারকে তাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছি। তারা এখনো কোনো উত্তর দেয়নি।
আমরা আদালতের নোটিসের অপেক্ষায় আছি, যা এই প্রক্রিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আল জাজিরা:
আপনি কি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রথমে চীন সফর করেছেন এবং তারপর ভারত যাওয়ার চেষ্টা করেছেন? এতে কি কোনো বার্তা ছিল?
মুহাম্মদ ইউনূস:
আমি সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। আমি ভারত সফরের অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি। তাই আমি চীন সফরে গিয়েছিলাম। এখন মালয়েশিয়া সফর করবো। আমি থাইল্যান্ডেও গিয়েছিলাম।
আমি চাচ্ছি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ককে আবার সক্রিয় করতে। আমি চাই বাংলাদেশসহ সব দেশ একসঙ্গে কাজ করুক।
আল জাজিরা:
আপনি কি বলছেন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন শীতল হয়ে গেছে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
আমি এটা স্থায়ী কোনো অবস্থা মনে করি না। এটা সাময়িক সমস্যা। আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক বিশ্বের অন্যতম সেরা সম্পর্ক হওয়া উচিত — আমি তাই বিশ্বাস করি।
আল জাজিরা:
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আপনার ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে অনুদান দেওয়া নিয়ে অসন্তুষ্ট। এখন ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় ফিরেছেন। আপনি কি ২০১৬ সালে দেওয়া সেই অনুদান নিয়ে অনুতপ্ত?
মুহাম্মদ ইউনূস:
না, আমাদের ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে। কোনো সমস্যা নেই। আমরা একসঙ্গে কাজ করছি এবং ভবিষ্যতেও দৃঢ় সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছি। আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত উষ্ণ ও ইতিবাচক।
আল জাজিরা:
আপনারা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আছেন। আপনি কি যুক্তরাষ্ট্রকে নির্ভরযোগ্য অংশীদার মনে করেন? নাকি এখন আপনাকে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কোনো একটা পক্ষ বেছে নিতে হচ্ছে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
না, এটা কোনো পক্ষ বেছে নেওয়ার প্রশ্ন না। আমাদের কাছে সবাই বন্ধু — যুক্তরাষ্ট্রও বন্ধু, চীনও বন্ধু, ভারতও বন্ধু। আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই।
আল জাজিরা:
তারপরও, ট্রাম্পের নীতির কারণে আপনাদের রপ্তানির ওপর শুল্ক বেড়েছে — এমন সময় যখন বাংলাদেশ একটা কঠিন সময় পার করছে। এতে কী প্রভাব পড়ছে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
এটা শুধু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নয়, এটা বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের একটি নীতি। আমরা এটাকে ব্যক্তিগতভাবে নিচ্ছি না। আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে যেতে পারি, যাতে উভয় পক্ষই উপকৃত হয়।
আল জাজিরা:
আপনি মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত। এখন এই ট্রেড ওয়ার (বাণিজ্য যুদ্ধ) এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের পরে, আপনি এখনো কি মুক্ত বাজার অর্থনীতিকেই বিশ্বের আদর্শ ব্যবস্থা বলে মনে করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
আমি বলবো, বর্তমান সভ্যতা নিজেই আত্মবিনাশের পথে। চেষ্টা করেও এই আত্মবিনাশের পথ থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের এখন একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে।
মুক্ত বাজার অর্থনীতি — যেটি শুধুমাত্র লাভের সর্বোচ্চীকরণ নিয়ে চলে — সেটি সমস্যা তৈরি করে। আমরা একটি বিকল্প ব্যবস্থা চাই, যেখানে মুনাফার পাশাপাশি থাকবে সামাজিক চেতনা, মানুষ শুধু নিজের লাভের জন্য না, সমাজের সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্যও ব্যবসা করবে। এটাকেই আমি বলি ‘সামাজিক ব্যবসা’ — যেখানে ব্যবসা লাভ করলেও সেই লাভ আবার সমাজের কল্যাণে বিনিয়োগ করা হবে, নিজের জন্য নয়।
আল জাজিরা:
আপনি দারিদ্র্য দূর করার জন্য কাজ শুরু করেছিলেন ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পর। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আপনি কী শিখেছেন — ভালো এবং খারাপ শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে, এবং দরিদ্রদের চাহিদা সম্পর্কে?
মুহাম্মদ ইউনূস:
দুটি বিষয় শিখেছি। প্রথমত, আমি বারবার বলেছি — দারিদ্র্য গরিব মানুষের সৃষ্টি নয়। দারিদ্র্য সৃষ্টি করে আমরা যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা তৈরি করেছি তা। আমি একটা উদাহরণ দিই — ‘বনসাই গাছ’।
আপনি যদি একটি বড় গাছের বীজ নেন এবং ছোট একটি টবে লাগান, তাহলে সেটি বড় হতে পারে না। গাছটি হবে সুন্দর, কিন্তু খর্বাকৃতি — কারণ জায়গা ছোট। মানুষের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমাদের সৃষ্টিশীলতা, আমাদের সম্ভাবনা — সবকিছুই এই ব্যবস্থার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের পুরো মানবজাতিকে যেন ‘বনসাই’ বানিয়ে রাখা হয়েছে।
আল জাজিরা:
আপনি বলেছেন — মানুষ ‘চাকরির জন্য’ জন্মায়নি। একটু ব্যাখ্যা করবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সৃষ্টিশীল। চাকরি নেওয়া মানে কারও আদেশ পালন করা, নিজের সৃষ্টিশীলতা হারানো। চাকরি আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। মানুষের আসল পরিচয় হলো — নিজের সৃজনশীলতা অনুসন্ধান করা, নিজেদের সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা।
আমরা এমন একটা অর্থনীতি তৈরি করতে চাই যেখানে প্রতিটি মানুষ উদ্যোক্তা হতে পারে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।
আল জাজিরা:
সংক্ষেপে বললে, আপনি কী বলতে চান?
মুহাম্মদ ইউনূস:
সংক্ষেপে, আমি বলবো — আমাদের নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে, যা ‘সামাজিক ব্যবসার’ ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে। এমন এক সভ্যতা, যা হবে মুনাফার লোভে পরিচালিত নয়, বরং সামাজিক চেতনায় চালিত, যেখানে সবার উন্নয়নই হবে প্রধান লক্ষ্য।
আল জাজিরা:
‘মনসুন বিপ্লব’ কি সবার জন্য ছিল — শহর ও গ্রাম, তরুণ ও বৃদ্ধ সবার?
মুহাম্মদ ইউনূস:
জুলাইয়ের এই অভ্যুত্থান (মনসুন বিপ্লব) একটি অসাধারণ ঘটনা ছিল। এটি সবাইকে একত্রিত করেছে- শহরের মানুষ, গ্রামের মানুষ, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও। এখানে কোনো বিভেদ ছিল না। সবাই একসাথে একই দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল।
আর অবাক করা বিষয় হলো — এটা মাসের পর মাস ধরে চলেনি; কয়েক ঘণ্টার নোটিসে আন্দোলন শুরু হয়ে, এক মাসের মধ্যেই শেষ হয়েছিল।
আল জাজিরা:
বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে এখনো ব্যাপক শ্রমিক নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সমালোচকরা বলেন, মাইক্রোফাইন্যান্স প্রকল্পও প্রকৃত দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করতে পারেনি। আপনি কী বলবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
মাইক্রোক্রেডিট (ক্ষুদ্রঋণ) সব সমস্যার সমাধান নয়। আমরা বলেছি — মানুষের নিজের জীবন গড়ার ক্ষমতা থাকা উচিত, তারা যেন কারও জন্য কাজ না করে নিজের জন্য কাজ করতে পারে।
আমার কথা সবসময় ছিল — মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই উদ্যোক্তা, কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থা তাদের তা হতে দেয় না। যেখানে প্রচলিত ব্যাংক কেবল ধনীদের ঋণ দেয়, গরিবদের দেয় না — আমি সেই ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছি। শ্রমিক অধিকারের সমস্যাটা আলাদা। আমরা সেই সমস্যা সমাধানে কাজ করছি। আমরা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সকল কনভেনশনে স্বাক্ষর করার প্রক্রিয়ায় আছি, যাতে আন্তর্জাতিক মান বজায় থাকে। আমরা এই দায়িত্ব খুব গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছি।
আল জাজিরা:
আপনি এখন ৮৪ বছর বয়সী, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি। তবুও কেন আপনি এখন এই রাজনৈতিক দায়িত্ব নিলেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
আমি তখন প্যারিসে ছিলাম। বাংলাদেশ থেকে ফোন এলো — শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, সরকার পতন হয়েছে, এখন নতুন সরকার গঠনের সময়। তারা বললো, আমি যেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হই। আমি প্রথমে বলেছিলাম — “না, আমি যুক্ত হতে চাই না।” আমি বললাম — “অনেক যোগ্য মানুষ আছে, তাদের খুঁজুন।” আমি সময় চাইলাম — ২৪ ঘণ্টা। পরের দিন আবার ফোন এলো।
তারা বললো — “আমরা চেষ্টা করেছি, সবাই বলছে, আপনাকেই আসতে হবে।”
তারা বললো, তরুণরা রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে — এখন আমি যদি পিছিয়ে যাই, সেটা হবে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আমি খুব দ্বিধায় পড়ে গেলাম। শেষ পর্যন্ত, তাদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করি। ৮ আগস্ট আমি ঢাকায় এসে সরকার গঠন করি।
আল জাজিরা:
শেষ প্রশ্ন: আপনার কাঁধে এখন বিশাল দায়িত্ব। বাংলাদেশ আগামী এক দশকে কেমন হবে বলে আপনি আশা করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:
এটা এক বিশাল দায়িত্ব, একই সাথে এক বিশাল সুযোগ। ইতিহাস আমাদের হাতে এক নতুন সূচনা উপহার দিয়েছে। আমরা একটি ‘পরিষ্কার পাতায়’ লিখতে পারছি। আমরা চেষ্টা করছি- শান্তিপূর্ণভাবে, আইনের শাসন মেনে, প্রতিটি ধাপে মানুষের আস্থা অর্জন করে নতুন বাংলাদেশ গড়তে। নির্বাচন শেষ করে জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবো।
আমরা চাই এই যাত্রাপথটি মানুষের জন্য আনন্দদায়ক ও গর্বের হোক।
ইংরেজি থেকে অনূদিত