অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে পতনের পর রাজনীতিতেও আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে সরকারে ফেরার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা। ফলে এক সময়ের রাজনৈতিক মিত্ররা বিএনপির কাছে অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তো রূপ নিয়েছে বৈরিতায়।
কিন্তু নির্বাচন ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে দেখে নতুন করে ভাবতে বসেছে বিএনপি। তাই পুরনো রাজনৈতিক মিত্রদের ডাকছে আবার বৈঠকে। শনিবার প্রথমে ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি, তারপর বৈঠক করেছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির সঙ্গে।
এই বৈঠকগুলো তখনই হচ্ছে, যখন অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সঙ্গে বিএনপির রেষারেষি চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনে বিএনপির কর্তৃত্ব চলছে বলে অভিযোগ তুলেছে এনসিপি। তা প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি বলছে, প্রশাসনের সঙ্গে এনসিপিরই বেশি সখ্য।
গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু এরপর দিন যত গড়িয়েছে, নানা প্রশ্নে তাদের দূরত্ব ততই বেড়েছে।
এই তরুণরা রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারে থেকে দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তখন দুই পক্ষে বেশ বাদানুবাদ হয়েছিল।

বিএনপির আপত্তির পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম গত ফেব্রুয়ারিতে উপদেষ্টার পদ ছেড়ে এসে এনসিপির আহ্বায়ক হন। তিনি এখন দাবি করছেন, প্রশাসন বিএনপির পক্ষে কাজ করছে।
গত বুধবার ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দুজন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর নাহিদ এই অভিযোগ তুলে বলেন, এভাবে চললে আগামী নির্বাচনে এনসিপি অংশ নেবে কি না, তা ভেবে দেখবেন তারা।
কয়েক মাস আগেই উপদেষ্টা হিসাবে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রকের স্থানে থাকা নাহিদের এই বক্তব্য ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
তার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য নাহিদ এমন বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি উল্টো বলেন, “প্রশাসনের সাথে বৈষম্যবিরোধীদের সখ্য সবচেয়ে বেশি। আমরা যতদূর জানি, তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে নজরদারি করে, দেখাশোনা করে।”
নানা বিষয়ে মতভেদের পর এখন নির্বাচনের সময় নিয়ে বিএনপি-এনসিপি বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। বিএনপি চাইছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন। এনসিপি বলছে, সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ ব্যর্থ হবে।
গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু ্ইউনূসের কাছে তাদের শুনতে হয়েছিল, নির্বাচন হবে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে নিজেদের অসন্তোষ গোপন রাখেননি বিএনপি মহাসচিব ফখরুল। তিনি সাংবাদিকদের খোলাখুলিই হলেন, তারা নির্বাচনের সময় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
সংস্কারের কোনো অগ্রগতি না দেখার মধ্যে এনসিপি গঠন এবং এরপর ‘সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়’ কিংবা ‘ইউনূস ৫ বছর থাকুক’ এমন প্রচার বিএনপির নীতি-নির্ধারকদের মনে ভয় ঢুকিয়েছে।
দলটির নেতারা সন্দেহ করছে, এসব প্রচারে অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্য থেকেই সমর্থন জোগানো হচ্ছে। ১/১১ এর মতো বিরাজনীতিকরণের আরেকটি চক্রান্ত ডালপালা মেলছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দ্রুত নির্বাচন না করা বা বিলম্বিত করার জন্য কোনো কোনো পক্ষের তৎপরতা আমাদের কাছে দৃশ্যমান এবং তাতে সরকারেরও কেউ কেউ জড়িত আছে বলে অনেকের কাছে মনে হচ্ছে।”
লন্ডন থেকে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও যে পরিস্থিতি বুঝতে পারেছেন, তা বোঝা যাচ্ছে যুক্তরাজ্যে যাওয়া জামায়াত আমিরেরে সঙ্গে তাদের বৈঠক এবং তারপর এই দলটিরও নির্বাচনে দেরি না করার দাবি তোলা।
ইউনূস ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বললেও তার কোনো রোডম্যাপ না দেখে সন্দেহ বাড়ছে বিএনপিতে।
সালেহ উদ্দিন বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন করার জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে প্রস্তুতি নেয়ার কথা তিনি বলছেন না বা সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিচ্ছেন না। আমরা এ বিষয়টিতেই স্পষ্ট হতে চাই।”
প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক থেকে নিরাশ হয়ে ফেরা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বৃহস্পতিবারই সভায় বসেন। সেখানে পরিবর্তিত যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিল, এমন সব দলকে নির্বাচন প্রশ্নে এক জায়গায় আনার উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এর লক্ষ্য হচ্ছে, নির্বাচনের দাবিতে রাস্তায় নামতে হলে অন্তর্বর্তী সরকার যেন তাদের পক্ষে কোনো রাজনৈতিক দলকে কাছে না পায়, সেটা নিশ্চিত করা।
সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে শনিবার প্রথমে ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সেলিমা রহমান।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে বৈঠকে ছিলেন বিএলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, জাগপার রাশেদ প্রধান, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল করিম খান প্রমুখ। এরপর এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে।
বৈঠকের কারণ ব্যাখ্যা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারাই রাজপথে ছিলেন, আমরা সবার সঙ্গে বসে কী করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি। এই আলোচনা শেষে আমরা বলব আপনাদের যে কী করা যায় বা কী করা যায় না।”
বিএনপি নেতারা বলছেন, সরাসরি সরকারের বিরোধিতা করার চিন্তা এখনও নেই। তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি ও নির্বাচনের জন্য মাঠে নামার প্রয়োজন হলে সবাই যেন একযোগে কর্মসূচি নিয়ে নামতে পারে- সেই প্রেক্ষাপট তৈরিই এখন দলটির লক্ষ্য।
নজরুল বলেন, “আমরা মনে করি না যে, তেমন কিছু দরকার হবে। কারণ এই সরকার যারা আছে, আমরাই এই সরকারকে বসিয়েছি এই প্রত্যাশায় যে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তারা ভূমিকা পালন করবেন। তারা জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করুন, এটা আমরা আশা করি।”
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে থেকে বিএনপির সঙ্গে থাকা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না নির্বাচনের মাধ্যমে সরার গঠনের মত জানিয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নির্বাচন ছাড়া তো ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নেই। সেজন্যই দলগুলো জরুরি সংস্কার ও নির্বাচনের কথা বলে আসছে। নির্বাচন ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই।”
বিএনপির মিত্র দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে একমত। এর বাইরে অন্য যেসব দল আছে, তাদেরও সাথে নিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়িয়ে তোলাই এখন বিএনপির উদ্দেশ্য।