ইউনূসের সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্ব বাধছে বিএনপির

ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এখন এই কার্ডটি ফেইসবুকে শেয়ার করছে বিএনপির সমর্থকরা।
ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এখন এই কার্ডটি ফেইসবুকে শেয়ার করছে বিএনপির সমর্থকরা।

‘ইনটেরিম রিমেম্বার, ইলেকশন ইন ডিসেম্বর’- সোশাল মিডিয়ায় এখন এই স্লোগান সম্বলিত এক কার্ড ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছে, মূলত বিএনপি সমর্থকরাই তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

কেবল একটি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে, জা্পানে একথা বলার পর এখন রাখঢাক না রেখে খোলাখুলিভাবেই প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করছেন বিএনপি নেতারা।

অথচ গত বছরের আগস্টে অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চিত্র ভিন্ন সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমে জামায়াত, এরপর জাতীয় নাগরিক পার্টির পর সরকারের দুই উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছিল। এখন খোদ ইউনূসের সঙ্গেই সরাসরি দ্বন্দ্ব বাধছে খালেদা জিয়ার দলের।

আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি যখন নির্দলীয় সরকারের আন্দোলন করছিল, তখন তাদের প্রস্তাবিত সেই সরকারের প্রধান হিসেবে ইউনূসকেই তারা ভেবে রেখেছিল বলে জানা যায়। তখন ইউনূসের ওপর শেখ হাসিনার খড়গহস্ত হওয়ার সেটাও একটা কারণ বলে ধরে নেওয়া হয়।

গত বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর যখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় অভ্যুত্থানকারীরা তরুণরা যখন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ইউনূসকে বেছে নিয়েছিলেন, তখন বিএনপিরও আপত্তির কোনো কারণ ছিল না।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এমনও বলেছিলেন, ইউনূস নেতৃত্বাধীন এই সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে তার দল।

এরপর দিন যত গড়াতে থাকে সেই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বাড়তে থাকলেও ইউনূসকে নিয়ে কোনো আপত্তি দেখা যায়নি।

তবে নির্বাচন নিয়ে ইউনূসের অস্পষ্ট কথায় বিএনপির সন্দেহ বাড়তে থাকলে দলটির নেতারা মুখ খুলতে শুরু করেন। এখন তো বলতে গেলে সেই কথার বাধ ভেঙে গেছে।

ইউনূস শুরু থেকে বলে আসছিলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। ন্যূনতম সংস্কার হলে ডিসেম্বরে, আর ব্যাপক সংস্কার হলে জুনে নির্বাচন হবে।

বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছিল। তারমধ্যে আদালতের রায়ের পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানোর উদ্যোগ না নেওয়ায় সরকারের সঙ্গে বিএনপির দ্বন্দ্ব বাধে।

তাতে বিএনপি অভিযোগ তোলে উপদেষ্টা পরিষদে থাকা অভ্যুত্থানের নেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমের দিকে। তাদের এবং সেই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিল আহমেদকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলে তারা।

সেই দাবি মানা না হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে আর সহযোগিতা করবে না বলেও হুমকি দেয় বিএনপি। তখন ইউনূসের পদত্যাগের একটি গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এটাও বলেন, প্রয়োজনে বিকল্প খুঁজে নেবে জনগণ।

তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই ইঙ্গিত মেলে যে অন্তর্বর্তী সরকারে ইউনূসকে এখন আর অপরিহার্য ভাবছে না বিএনপি।

এদিকে ডিম্বেরে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি অবস্থান কঠোর করার পরও জাপানে গিয়ে বুধবার ইউনূস ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেন। অথচ সেদিনই তারেক রহমান বলেছিলেন, নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই হতে হবে।

এর একদিন বাদে আরেকটি সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে বলেন, “এই সরকার কোনোভাবেই জবাবদিহিমূলক নয়, জনগণের কাছে এই সরকারের জবাবদিহি করার সুযোগও নেই।”

নির্বাচন নিয়ে সরকারের অস্পষ্ট অবস্থানে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মনে হয় এরই ভেতরে টালবাহানা শুরু হয়েছে বা চলছে। কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের অভিনব শর্তের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ।

“জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ও বাইরে কারও কারও মনে হয় ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।”

এরপর জাপানে নিক্কেই ফোরামে এক অধিবেশনে ইউনূস আবার বলেন যে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেখানে এক প্রশ্নে তিনি বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলেন, সব রাজনৈতিক দল নয়, শুধু একটি দল এটা বলছে।

তার সেই কথা বলার পর বিএনপি নেতারা এখন ইউনূসের সমালোচনা সরাসরি করছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী শুক্রবার চট্টগ্রামে এক সভায় বলেন, “কোনো কথা বললে, তা দেশের মধ্যে বললে ভালো। দেশের বাইরে গিয়ে বেশি কথা না বলে দেশের ভেতরে বললে ভালো।”

একই দিনে ঢাকায় এক সভায় স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বিএনপিকে তার মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছেন।

“তিনি জাপানে বসে বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। জাপানে বসে বলেছেন, একমাত্র বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়।”

ইউনূসের বিরুদ্ধে কথা না রাখার অভিযোগও করেন মির্জা আব্বাস। তিনি দাবি করেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপে ইউনূসই প্রথম ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা বলেছিলেন।

“ড. ইউনূস সাহেব আপনি স্মরণ করে দেখুন, ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা আপনিই প্রথম বলেছেন। আমরা বাইরে চলে আসার পরে সন্ধ্যা ছয়টা বা সাড়ে ছয়টার সময় আপনার প্রেস সেক্রেটারি বলেছে, জুন মাসে নির্বাচন হতে পারে। প্রেস সেক্রেটারি আর আপনি তো এক কথা নয়।”

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশিদের হাতে দেওয়ার বিরোধিতা করে মির্জা আব্বাস বলেন, “কেন এই টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে দেব? বিদেশিরা এলে টাকা বাংলাদেশে রাখবে না। তাই বিদেশিদের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা ছেড়ে দেন।”

তিনি আরও বলেন, “সেন্ট মার্টিনে খাওয়া নেই, কাপড় নেই, মানুষ বাচ্চা নিয়ে স্কুলে যেতে পারে না। সেন্ট মার্টিনে কী এমন হয়ে গেল যে বাংলাদেশি নৌকা যেতে পারবে না? সেখানে কী এমন ঘটনা ঘটছে, জানতে চাই।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় তো কয়েকদিন আগেই হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, বিএনপি রাজপথে নামলে অন্তর্বর্তী সরকার ভেসে যাবে

বুধবার নয়া পল্টনের সমাবেশে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলামও হুঁশিয়ার করে বলেন, প্রয়োজনে তারা ইউনূসের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঘোষণা দেবেন।

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দূরত্বের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরোধিতায় বিএনপি ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে বলে কয়েকদিন আগেই প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল মাহমুদুর রহমান সম্পাদিত আমার দেশ।

কিন্তু ডিসেম্বরে নির্বাচন আর কোনও দল চায় না- ইউনূস একথা বলার পর বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল দাঁড়িয়ে গেছে বিএনপির পাশে।

বাম গণতান্ত্রিক জোট, ১২ দলীয় জোট, গণফোরামসহ বিভিন্ন দল বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ডিসেম্বরে নির্বাচনের েয দাবি বিএনপি তুলেছে, তার সঙ্গে তারাও রয়েছে। জাতীয় পার্টিসহ আরও দলের সমর্থনও ডিসেম্বরে নির্বাচনের দিকে।

ফলে ইউনূসকে চ্যালেঞ্জ জানাতে বিএনপি আটঘাট বেঁধেই নামছে বলেই অনুমান করা যায়।

আরও পড়ুন