শেখ হাসিনা দেশছাড়া, খালেদা জিয়াও দেশে নেই। শুধু কি তাই, বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শিবির যে দুই নেত্রীর পরিবারকে ঘিরে আবর্তিত, সেই বঙ্গবন্ধু ও জিয়া পরিবারের একজন সদস্যও এই মূহূর্তে দেশে নেই। এমনটি কি বাংলাদেশে কখনও কেউ দেখেছে? অথচ তাই ঘটেছে।
২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে জরুরি অবস্থা জারির পর দুই নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার চেষ্টা হয়েছিল, তাদের গ্রেপ্তার করে পাঠানো হয়েছিল কারাগারে। দলের মধ্যেও তাদের বাদ দেওয়ার চেষ্টা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বরঞ্চ দলে দুজনের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়।
‘ওয়ান-ইলেভেনের’ সময় দৃশ্যমান যে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, দেড় যুগ পর আবার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন কি অদৃশ্যে থেকে কেউ সেই চেষ্টা চালাচ্ছে? বিএনপি নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে তার একটি ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যদিও তারা মুখ ফুটে কিছু বলছেন না, বলছেন আকারে-ইঙ্গিতে।
‘মাইনাস টু’ মানে খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনা বাদ। ২০০৭-০৮ সালে ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শব্দবন্ধটি ছিল সবার মুখে মুখে। ২০০৭ সালের ১১ জুন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ‘দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে’ শিরোনামে যে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলেন, তা ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র অংশ বলেই মনে করা হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে।
দেড় দশক কঠোর হাতে দেশ শাসনের পর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আপাতত বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘মাইনাস’ হয়ে গেছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হয়ে আছেন ভারতে।
বোনের সঙ্গে সেদিন ভারতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর আরেক মেয়ে শেখ রেহানাও। পরে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান বলে খবর মিলছে। শেখ রেহানার দুই মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যে থাকেন, সেদেশের মন্ত্রীও তিনি। আরেক মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীও যুক্তরাজ্যে। রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক এতদিন দেশে থাকলেও তিনিও এখন বিদেশে।
জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান দুজনই ২০০৭ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে দুজনই দেশ ছাড়েন। তারেক সপরিবারে গিয়ে ওঠেন যুক্তরাজ্যে। মালয়েশিয়ায় গিয়ে ওঠা আরাফাত কয়েক বছর পর সেখানেই মারা যান। তার স্ত্রী ও মেয়েরা এরপর যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান।
দেশে থাকা খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সরকার আমলে দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে ২০১৮ সালে যেতে হয়েছিল কারাগারে, দুই বছর পর শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি নিয়ে বাড়িতে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ হয়ে যায়, পুরোপুরি মুক্ত হন তিনি।
অভ্যুত্থানের পর দেশ বঙ্গবন্ধু পরিবারশূন্য হয়ে পড়ার পর জিয়া পরিবারের কেবল খালেদা জিয়াই ছিলেন দেশে। তিনিও চিকিৎসার জন্য গত মঙ্গলবার লন্ডন চলে গেছেন, তার সঙ্গে ছেলে আরাফাতের স্ত্রী শর্মিলা রহমানও দেশ ছাড়েন।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার সময়ই মাঝে-মাঝে বলতেন, অনির্বাচিতদের ক্ষমতায় আনতে নানা ষড়যন্ত্র চলছে। অভ্যুত্থানের পর আগস্ট মাসের শেষ দিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও আবার ‘মাইনাস টু’র শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন; বলেছিলেন, ওয়ান-ইলেভেনের মতো বিরাজনীতিকীকরণের চেষ্টা হতেও পারে।
সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ এসেছিল, কিন্তু এবার হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। ফলে সেনাবাহিনী চালকের আসনে নেই। তবে তাদের ক্ষমতার গুরুত্ব অস্বীকারের উপায়ও নেই। ফলে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান দেখা করে আসার পর যখন খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রার দিনক্ষণের ঘোষণা এলো, তখন তাতে ইঙ্গিত খোঁজেন বিএনপিরও অনেকে।
এর মধ্যেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী শুক্রবার ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নে ‘মাইনাস টু’র প্রসঙ্গ টানেন বলে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে খবর ছাপা হয়েছে।
আমীর খসরু বলেন, “বিরাজনীতিকরণ বা মাইনাস টু, কেউ যদি এ রকম মনগড়া কথা বলে, এটা তাদের সমস্যা। এখানে মাইনাস টু’র কথা যারা বলে, এটা তাদের উইশফুল থিঙ্কিং। ওই আশা জীবনেও পূরণ হবে না।”
কিন্তু ‘মাইনাস টু’র বিষয়ে কারা বলেন? কাদের আশা পূরণ না হওয়ার কথা বলছেন আমীর খসরু? তা স্পষ্ট হচ্ছে না। আর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে এমন কথা এখনও কারও মুখে থেকে আসেনি।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যেখানে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে না দেওয়ার বিষয়ে বদ্ধপরিকর, সেখানে তারা শ্রদ্ধার মনোভাব নিয়েই খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার সম্প্রতি সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, ‘মাইনাস টু’র কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।
তবে বিএনপির নানা নেতার নানামুখী বক্তব্য পর্যবেক্ষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিএনপি একটা অস্থিরতায় ভুগছে দলগতভাবে। তারা শঙ্কায় ভুগছে এক-এগারোর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না?”
কেন এই শঙ্কা- তা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবায়দা নাসরীন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিএনপি এখন নির্বাচন চায়। অন্যদিকে সরকার ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ বিএনপিকে ইঙ্গিত করে নানা কিছু বলছে। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দেশের বাইরে। কিছু প্রশ্ন, উদ্বেগ কিংবা উৎকণ্ঠা তো মানুষের মনে আসবেই এবং এটাই স্বাভাবিক। এক-এগারোর অভিজ্ঞতা বিএনপির নেতা-কর্মীরা তো ভুলে যায়নি।”