বিবিসির প্রতিবেদন নিয়ে ছাত্রলীগের তীব্র প্রতিবাদ, ‘তথ্যবিচ্যুতি ও পক্ষপাতের’ অভিযোগ

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ লোগো।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ লোগো।

ছাত্র আন্দোলন দমাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথিত গুলির নির্দেশ নিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

পাশাপাশি ওই প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা, বস্তুনিষ্ঠতা ও উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সংগঠনটি।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বুধবার প্রামাণ্যচিত্র ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিসি। ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, অভ্যুত্থান দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রাণঘাতী দমন-পীড়ন চালানোর অনুমোদন শেখ হাসিনাই দিয়েছিলেন।

‘ফাঁস হওয়া’ একটি অডিও টেপ যাচাই করে তার সত্যতা পেয়েছে বলেও দাবি করে বিবিসি আই ইনভেস্টিগেশন।

বিবিসির ওই প্রতিবেদনের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বলেছে, প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি “মারাত্মক দমন অভিযান” অনুমোদন দিয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে, যা একাধিক পদ্ধতিগত ত্রুটি, তথ্যগত অসামঞ্জস্যতা এবং পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যায় পরিপূর্ণ।

বিবিসি আই ইনভেস্টিগেশন ও বিবিসি বাংলা যৌথভাবে ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।

এরকম প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিবিসি তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও সাংবাদিকতার নীতিমালা গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন করেছে বলেও ছাত্রলীগের অভিমত।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের এই সহযোগী সংগঠনটিকে এরই মধ্যে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করেছে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।

সংগঠনের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত ইংরেজিতে লেখা ছাত্রলীগের ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, প্রতিবেদনটিতে পুরো অডিও রেকর্ড প্রকাশ না করে কেবলমাত্র ১৮ সেকেন্ডের একটি সংকলিত অংশ শোনানো হয়েছে, যা দুইটি ভিন্ন ক্লিপ থেকে কেটে নেওয়া ও মনগড়াভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ধরনের অসম্পূর্ণ উপস্থাপনাকে কোনওভাবেই প্রকৃত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলা যায় না।

বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তারা ইয়ারশট নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ‘ফাঁস হওয়া’ অডিও টেপ যাচাই করে সত্যতা পেয়েছে।

“ইয়ারশট শুধুমাত্র ক্লিপটির কারিগরি সম্পাদনার সত্যতা যাচাই করেছে, কিন্তু আলোচিত কথোপকথনের পূর্ণ প্রেক্ষাপট, সময় বা প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে কোনও প্রমাণ উপস্থাপন করেনি। এই ধরনের একতরফা উপস্থাপনা সাংবাদিকতার নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃতির আশঙ্কাকে উস্কে দেয়,” বলেছে ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগ বলছে, “প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে অডিওটি ১৮ জুলাইয়ের, কিন্তু এই দাবি ফরেনসিক পদ্ধতিতে নির্ভরযোগ্যভাবে যাচাই করা হয়নি। বরং এই তথ্যের ভিত্তি “লিক হওয়া অডিও সম্পর্কে অবগত অজ্ঞাত সূত্র”, যা আরও অস্পষ্টতা সৃষ্টি করে।

বিবিসি যে অডিও টেপকে ভিত্তি ধরে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে তা একটি দীর্ঘ কথপোকথনের খণ্ডিত অংশ বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। তবে কবে, কোথায় ও কোন প্রেক্ষাপটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওই নির্দেশনা দিয়েছিলেন সে সম্পর্কেও বিবিসির প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না।

একই সঙ্গে ওই অডিও টেপের উৎস সম্পর্কেও বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি বিবিসির প্রতিবেদনে।

ছাত্রলীগের বিবৃতিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, “কেন সম্পূর্ণ রেকর্ডিং প্রকাশ করতে পারেনি বা সেই ‘অজ্ঞাত সূত্রের’ মাধ্যমে কেন পুরো বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়নি বিবিসি। এই অনাবিষ্কৃত তথ্য এবং অপ্রকাশিত সূত্রের ওপর নির্ভরশীলতা প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে গুরুতর সন্দেহ তৈরি করে।”

বাংলাদেশের আইনগত প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নিয়েই বিবিসি একপাক্ষিকভাবে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বলেও অভিযোগ করা হয় ওই বিবৃতিতে।

এতে বলা হয়, বাংলাদেশ পুলিশ একটি নির্ধারিত আইনগত কাঠামোর আওতায় কাজ করে এবং তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রী থেকে ‘অনুমতি’ নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। সারা বিশ্বে স্বীকৃত আইনি নীতিমতে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আত্মরক্ষা এবং জননিরাপত্তা রক্ষার অধিকার রাখে, যা উচ্চ পর্যায়ের অনুমতির ওপর নির্ভরশীল নয়।

জুলাই-অগাস্টের ঘটনাপ্রবাহকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের ‘সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে।

বিবিসি বলছে, তাদের ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অনুসন্ধানে ঢাকায় বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশি হত্যাযজ্ঞের নতুন কিছু তথ্য উঠে এসেছে, যা আগে এতটা স্পষ্টভাবে আসেনি। এই অনুসন্ধানে মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক বেশি পাওয়া গেছে।

ছাত্রলীগের বিবৃতিতে বলা হয়, বিবিসির ওই প্রতিবেদনে জুলাই থেকে আগস্ট ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে পুলিশ স্টেশন, সরকারি দপ্তর, কেপিআই এবং বেসামরিক জনগণের ওপর হামলার বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

“এসব ঘটনা ছিল একটি পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ, যার লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় অঙ্গনকে অচল করা। জাত্রাবাড়ী ওভারপাসে পুলিশের গায়ে ফাঁসি দেওয়াসহ পুলিশ সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ড ছিল সন্ত্রাসবাদ ও বিদ্রোহের জঘন্য উদাহরণ। ১৮ জুলাইয়ের পূর্ব পর্যন্ত সরকার “পূর্ণ বল প্রয়োগের” অনুমতি স্থগিত রেখেছিল। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই আইনি কাঠামো বিবেচনায় না এনে বিবিসির উপস্থাপন একতরফা ও বিভ্রান্তিকর।”

আওয়ামী লীগের এই সহযোগী সংগঠন অভিযোগ করেছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সংগঠিত সন্ত্রাস, সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর হামলার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে বিবিসি। ওই সময় বহু পুলিশ সদস্যকে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়, যার পেছনে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ সংগঠন যেমন হিযবুত তাহরির ও লস্কর-ই-তৈয়বার সংশ্লিষ্টতা ছিল।

“ইউনূসপন্থী গোষ্ঠী এবং নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম এনসিপির সদস্যরাও” এসব সহিংসতায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে বলে ছাত্রলীগের দাবি।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, বিবিসির প্রতিবেদনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, আওয়ামী লীগ-সমর্থক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সংঘটিত সহিংসতা ও গণপিটুনির ঘটনাগুলো সম্পূর্ণভাবে আড়াল করা হয়েছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে গণঅভ্যুত্থানকে সফল করতে যেসব ছাত্র-জনতা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের মাঠে থেকে এর পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ১৫ জুলাই থেকে ৮ অগাস্ট পর্যন্ত সংগঠিত গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য মামলা, গ্রেপ্তার বা হয়রানি থেকে রেহাই দিতে দায়মুক্তির ডিক্রি জারি করে।

ছাত্রলীগের বিবিৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতা ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল যখন উদ্বেগ প্রকাশ করছে, সেই সময়কে বিবিসির এরকম একটি প্রতিবেদন প্রকাশে সময় হিসেবে বেছে নেওয়ায় মনে হচ্ছে এটি ইচ্ছাকৃতভাবে বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের ব্যর্থতা থেকে নজর সরিয়ে পূর্ববর্তী নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার পরিকল্পনারই একটি অংশ।

বিবিসির প্রতিবেদনকে “বিভ্রান্তিকর, পক্ষপাতদুষ্ট এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” আখ্যায়িত করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের প্রতি রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের আহ্বান জানিয়েছে ছাত্রলীগ।

আরও পড়ুন