সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে মারামারিতে বাংলাদেশ-ভারতের কৃষকরা

chapai-border-bgb-bsf-180125-02

বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ঢাকা-নয়া দিল্লি সম্পর্ক এখন নাজুক; তার মধ্যে দুই দেশের কূটনীতিকদের পাল্টাপাল্টি তলবও চলছে। তা যে দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে, তা টের পাওয়া গেল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের ঘটনা।

শনিবার দিনভর এই সীমান্তে চলে উত্তেজনা; এপারে শিবগঞ্জ উপজেলার কিরণগঞ্জ ও চৌকা, ওপারে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা। দুই দেশের কৃষকরা কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে জড়ায় মারামারিতে। ইট ছোড়াছুড়ির পাশাপাশি বোমা বিস্ফোরণও ঘটে। তা থামাতে বেগ পেতে হয় বিজিবি ও বিএসএফকে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা আবার কাঁদানে গ্যাসও ছোড়ে।

শেষে অন্তত চারজন আহত হওয়ার পর উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হস্তক্ষেপে রাত নাগাদ পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।

কী কারণে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত, তা নিয়ে ভারতীয় কৃষকরা দায়ী করছে বাংলাদেশিদের; অন্যদিকে বাংলাদেশিরা দায়ী করছে ভারতীয়দের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের চৌকা এবং নওগাঁ সীমান্তের ভারতের দিকের অংশে বেড়া নির্মাণ নিয়ে জানুয়ারির শুরু থেকেই কিছুটা উত্তেজনা চলছিল। তবে তা সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যেই ছিল কেন্দ্রীভূত। দুই বাহিনীর পতাকা বৈঠকে পরিস্থিতি শান্তও হয়েছিল।

তারপরই কিরণগঞ্জ ও চৌকা সীমান্তের মাঝামাঝিতে শনিবার দুই দেশের কৃষকরা মারামারিতে জড়াল।   

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-বিজিবির রাজশাহী সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল ইমরান ইবনে রউফ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘খুব মাইনর’ একটি ঘটনা ধরে মারামারির সূত্রপাত।

তিনি বলেন, “সকাল বেলা সম্ভবত আমাদের কয়েকটা ছেলে গ্রিন লাইনের ওই পাড়ে ঘাস কাটতে গিয়েছিল। ভারতের দাবি, হলো, ঘাস কাটার সময় তারা গম ক্ষেত থেকে কিছু গম কেটেছে।”

শিবগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজহার আলীও বলেন, ওই ফসল কাটা নিয়ে বাক-বিতণ্ডা থেকেই মারমারির সূত্রপাত।

সীমান্তবাসীকে উদ্ধৃত করে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, সীমান্তের শূন্যরেখার পাশে বাংলাদেশের ভেতরের জমিতে ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন দুই যুবক। এসময় ফসলি জমি বিনষ্টের অভিযোগ তুলে তাদের মারধর করে ভারতীয়রা। ওই ভারতীয়রা তখন বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে কয়েকটি আমগাছ কেটে দেয় এবং ফসলি জমি নষ্ট করেন। এতে ক্ষিপ্ত বাংলাদেশিরা সীমান্তে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। তখন ওপারেও ভারতীয় নাগরিকরা জড়ো হয়। দুপুরের দিকে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি বেঁধে যায়।

অন্যদিকে ভারতের সংবাদপত্র হিন্দুস্থান টাইমস বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, বেলা পৌনে ১১টার দিকে শুকদেবপুর সীমান্ত ফাঁড়ির কাছে আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছে কর্মরত ভারতীয় কৃষকরা বাংলাদেশি কৃষকদের বিরুদ্ধে ফসল চুরির অভিযোগ করেন। মৌখিক তর্ক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, উভয় পক্ষের কৃষকরা প্রচুর সংখ্যায় জড়ো হয়, একে অন্যকে উদ্দেশ করে গালাগালি করতে থাকে। পাল্টাপাল্টি পাথর ছুড়তে থাকে।

মারামারির বিষয়ে বিজিবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “গাছ কাটাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশি ও ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। হাতাহাতির এক পর্যায়ে আনুমানিক ৩০০-৪০০ জন ভারতীয় নাগরিক এবং তিন থেকে চার হাজার বাংলাদেশি নাগরিক সীমান্তে শূন্যরেখায় সমবেত হয়। তারা একে অপরকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে।”

বিজিবি কর্মকর্তা ইমরান বলেন, যে এলাকায় ফসল কাটা নিয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত, সেখানে মূলত দুই দেশের কৃষকই কাজ করে।

“শুরুটা খুব মাইনর। কারণ ওদের (ভারতের) ভেতরে নিয়মিত আমাদের লোকজন ঘাস কাটতে যায়। এখন আট ইঞ্চির মতো গমের ক্ষেত আছে। ওটা তো দেখতে ঘাসের মতোই।”

দিনভর মারামারি

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের এক বিবৃতিতে বলা হয়, পৌনে ১২টা থেকে সীমান্তে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি শুরু হয়।

স্থানীয় সাংবাদিক কাওসার আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ভারতীয়রা প্রথমে সরাসরি এসে আমগাছ, সরিষা ক্ষেত, ভুট্টা, বড়ই গাছ নষ্ট করেছে। তারপরে বিএসএফ নিজেই সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।”

তার ভাষ্য অনুযায়ী, ভারতীয় কৃষকরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে এবং পাথর ছোড়ে। বাংলাদেশি কৃষকরা তখন ক্ষেতের ঢিল ছুড়তে থাকে। কেউ কেউ আবার দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটাও নিয়ে আসে।

আব্দুল কাদের নামে স্থানীয় একজন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় নাগরিকরা যখন ফসল নষ্ট করে, তখন সাথে বিএফএফ ছিল। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। ওরা পাথর ছুড়ছিল। ককটেল জাতীয় বম্বিং করছিল।”

আক্রমণের মুখে বাংলাদেশিরা মাইকিং করে লোক জড়ো করে বলে জানান তিনি।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. বাদশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভারতীয়দের ছোড়া পাথরে কালিগঞ্জ গ্রামের ফারুক ও সুজন নামে দুজন আহত হন। বিশ্বনাথপুর গ্রামের মো. রনি ভারতীয়দের হাসুয়ার কোপে আহত হন। এছাড়া আহত হন নামো টোলা গ্রামের মেসবাউল হক মেসবাহ।

ভারতের পক্ষে কেউ আহত হয়েছে, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি বলে বিএসএফের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

কাঁটাতারের  বেড়া খোলার কারণই কি?

সীমান্তে এই মারামারির সময় বিএসএফের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিজিবির সেক্টর কমান্ডার ইমরান ইবনে রউফ।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিএসএফ ম্যানেজমেন্টে একটা ভুল করছে। যখন কৃষকরা গাছ-টাছ কাটার চেষ্টা করছে এবং আমাদের অনেক লোক সেখানে জড়ো হয়েছে, তারা তাদের কাঁটাতারের গেটটা খুলে দিয়েছিল তখন।

“এটা করার কথা না। ওরা খুলতে পারে, এটা কোনো ভায়োলেশন না। কিন্তু সাধারণত ওরা সকালে একবার আর বিকালে একবার খোলে। বাকিটা সময় বন্ধ রাখে। আজকে ওরা খুলে দিয়েছিল ওই সময়।”

ওপার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড বা কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার নিয়ে তিনি বলেন, “যখন দেখল, (দুই পক্ষই) গ্রিন লাইনের মাঝে মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে, তখন বিএসএফ তাদের নাগরিকদের দিকে সাউন্ড গ্রেনেড মেরেছে, সরানোর জন্য। বা, দু’দিকেই মারছে। টিয়ার শেলও মেরেছে।”

ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়, বিএসএফ এবং বিজিবি সদস্যরা উভয় দেশের কৃষকদের ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

বিজিবি কর্মকর্তা ইমরান বলেন, “যখন ডালপালা কাটতে আসছে, তখন বাধা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল কি না, আমি জানি না। তবে তারা (বিএসএফ) চেষ্টা করে নাই। চেষ্টা করলে করতে পারত। বরং, তারা উল্টো গেট খুলে দিয়েছে।”

তবে বিএসএফ বলেছে, অঞ্চলটি বিস্তীর্ণ ও বেড়াহীন হওয়ার কারণে ভারতীয় কৃষকরা অবাধে সীমান্ত অতিক্রম করে মারামারিতে জড়াতে পেরেছে।

পরিস্থিতি শান্ত হতে সন্ধ্যা পার

দুপুরে শুরু হওয়ার মারামারির থামিয়ে পরিস্থিতি শান্ত হতে হতে রাত নেমে যায়।। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিকাল ৪টার পরে পতাকা বৈঠকে বসে, তখনও উত্তেজনা চলছিল। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় দুই দেশের বাহিনী দুই দেশের জনগণকে পেছনে নিয়ে যাবে।

বিজিবি কর্মকর্তা ইমরান সন্ধ্যায় বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “আমরা যখন বলছি লোকজন সরাইতে, তখন তারা লোকজন ওই পাড়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিছে। ওদের সেই সুবিধা আছে। কাঁটাতারের বেড়া আছে। ওরা কাঁটাতারের দরজা বন্ধ করে দিছে।

“কিন্তু আমাদের লোকজনকে আনতে আমাদের সময় লাগছে। কারণ আমাদের লোকজন সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রিন লাইনের ওইখানে ছিল।”

এরপর রাত সাড়ে ৮টার পর বিজিবির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল ইমরান জানান, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেখানে বাড়তি বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

হিন্দুস্থান টাইমস বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএসএফ ও বিজিবি সদস্যদের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। উভয় পক্ষের কৃষকদের ছত্রভঙ্গ করে তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে ফেরত পাঠানো হয়।

বিএসএফ এ জাতীয় বিরোধ এড়াতে ভারতীয় কৃষকদের সীমান্তে কৃষি সম্পর্কিত যে কোনো সমস্যায় সরাসরি বিএসএফ সদস্যদের জানাতে বলেছে।

পতাকা বৈঠকে বিজিবির পক্ষে নেতৃত্ব দেন ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া। বিএসএফের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ১১৯ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমান্ড্যান্ট সুরাজ সিং। এছাড়া উভয় বাহিনীর তিনজন করে সদস্য বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে গোলাম কিবরিয়া বলেন, “বৈঠকে গাছ কাটার ঘটনায় বিএসএফ দুঃখ প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা।”

আরও পড়ুন